মোঃ আরাফাত হোসেন
দুই হাজার কোটি বছর আগেঃ
কয়েকদিন ধরে এই জায়গাটা কেমন যেন গন্ধ গন্ধ লাগছে। এমন মনে হচ্ছে কেন? এই পাহাড় আর আধো জঙ্গলভরা পরিবেশে সে বড় হয়েছে। কখনো তো মনে হয়নি যে আশেপাশে কোন পরিবর্তন হচ্ছে বা হবে। আজ কি তার শরীর খারাপ করেছে?
উত্তর জানা নেই, জানার কোনো ইচ্ছাও নেই। কারণ এই মূহুর্তে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়েছে অদ্ভুত এক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ ছোট-খাটো না। বিশাল রকমের যুদ্ধ। মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে তাদের চলে যেতে হবে। কিন্তু তারা যাবে কোথায়? এতো সুন্দর মায়াময় সবুজ পরিবেশ ছেড়ে কি কোনো প্রাণীর চলে যেতে মনে চায়? তবুও কখনো কখনো বাস্তবতাকে স্বীকার না করে পারা যায় না। আকাশ-বাতাস ছিমছাম নীরবতা পালন করছে। খুবই গম্ভীর প্রকৃতির নীরবতা। যা দেখে বোঝা যায় যে কিছু একটা ঘটার সময় হয়ে এসেছে। তার বুক ফেটে কষ্ট বেরিয়ে আসছে। মানুষ কষ্ট পেলে কান্না করে হাল্কা হয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃতিতে তাদের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কষ্ট পেলে তাদের দম আটকে মরে যেতে ইচ্ছে করে। কারণ বুকের ভিতর তখন এক গাদা হাহাকার প্রচন্ড বেগে আছড়ে পড়ে। সেই বেগ রোখার ক্ষমতা অনেকের আছে, কিন্তু তার নেই। সে ইচ্ছে করলেই এখন মরে যেতে পারে। তবে এখন মরতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে ঘটনার শেষ দেখে যেতে। মানুষের মত তারও সব বিষয়ে প্রচুর আগ্রহ আর আশ্বাস আছে। এই গুণটি সে পেয়েছে তার সহধর্মীর কাছ হতে। ভাবতে ভাবতে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে আবেগে। আচমকা কাছাকাছি কোথাও হতে বুক ফাটানো জন্তুর কর্কশ তীব্র আর্তনাদ শোনা যায়।
সে একটা মাটির ঢিবির আড়ালে লেজ নামিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। তাকে এখন নিশ্চয়ই হণ্য হয়ে খুঁজছে জন্তুগুলো। যেকোনো মূহুর্তে পেয়ে যেতে পারে। তার আগেই শেষ কাজটা সমাধা করতে হবে। ভাবতে ভাবতে পাহাড়ের মতন দেখতে ঢিবির খানিকটা উপর দিয়ে দিগন্তে উঁকি দেয় সে। যত দূর চোখ যায় একে একে লম্বা-নিচু গাছের সারি। অনেক দূরে একটা ছোট খালের মত নদী দেখা যাচ্ছে। তারপর আবার বিশাল বনের সারি। তারপর সমুদ্র। কতগুলো অদ্ভুত সুন্দর পাখি আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই পাখিগুলোর মাংস খেতে খুব সুস্বাদু- তার জন্য না, তার সহধর্মীর জন্য। সে মাংস খায় না। এখন অবশ্য এতসব চিন্তা করার সময় নেই। তবুও স্মৃতি খানিকটা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে তাকে। পাখিগুলো কেমন একটা নির্দিষ্ট গতিতে নির্দিষ্ট ছন্দে সমান পরিধি নিয়ে আকাশে উড়ছে। এক, দুই, তিন, পাখিগুলো উড়ছে আকাশে। স্বাধীনভাবে ডানা মেলে। পরমূহুর্তে আবার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা যায় একটা জন্তুর। তারপর আবার নীরবতা।
কয়েক মাস আগেঃ খোয়াক্ খোয়াক্ শব্দ করে একটা বড় খোলা ময়দানে খেলছে কয়েকটা ডাইনোসর। পাশেই তাদের বাবা-মা উজ্জল রোদের আলোয় রোদ পোহাচ্ছে। সামনে ছোট একটা খালের মত নদী। তারপর বিশাল অংশ জুড়ে সারি সারি উঁচু-নিচু গাছ, তারপর বিশাল সমুদ্র।
পিছনদিকে আবার বেশ কয়েকটা পাহাড়ের মত উঁচু মাটির ঢিবি রয়েছে। সেখানের মাটির সুরঙ্গে ডাইনোসরদের বাচ্চাগুলো প্রায়ই খেলাচ্ছলে ঢুকে পড়ে। তখন তাদের বাবা-মা চিৎকার করে ডেকে নিয়ে আসে।
-এই নাসরিন,অপি,মান্না জলদি বেরিয়ে আয়। কত্ত বড় সাহস তোদের! তুই ডিপজলের গর্তে ঢুকেছিস! এক্ষুণি ও তোকে কামড়ে দিবে। বেরিয়ে আয় বলছি।
বাচ্চাগুলো মায়ের বকুনী শুনেই হোক, কিংবা ডিপজলের ভয়েই হোক- হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে। ডিপজল হলো এই জঙ্গলের সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণী। ময়াল সাপ। এই সাপ সাইজেই যে শুধু বড় তা না, বিশাল দুটো বিষদাঁতও আছে এর। সেগুলো দিয়ে কামড়ে ধরলে তৃণভোজি ডাইনোসররা সাথে সাথে মরে যায়। আর যারা মাংসভোজী ডাইনোসর, তাদের মরতে সময় লাগে। ততক্ষণে অবশ্য মাংসভোজী ডাইনোসররাও ময়াল সাপের মাথা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এই জন্য সেই ময়াল সাপ, মানে ডিপজল সাপ পারতপক্ষে ডাইনোসরদের ঘাটাঘাটি করে না।
জঙ্গলে ডাইনোসরদের দুটি গোত্র আছে। একটি হল তৃণভোজী, অন্যটি হলো মাংসভোজী গোত্র। তৃণভোজীরা শান্ত-শিষ্ট ও কাটাবিহীণ লেজের অধিকারী। মাংসভোজীরা এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু রেগে গেলে ভীষণ গরম মার্কা হয়ে যায়। তখন তাদের কাটাযুক্ত লেজ খালি অস্থির ভঙ্গিতে নড়ে, আর পলকে পলকে সেই লেজ পুরো এলাকার বনের মাটি কাঁপিয়ে তোলে। তাদের মুখ হতে ফক্কশ ফক্কশ শব্দে আগুনের কুন্ডলী বের হয়।
মাংসভোজী একটা ডাইনোসর আছে এই জঙ্গলে। অন্যান্যদের চেয়ে বেশ শান্ত আর মায়া কাড়া অবয়ব পেয়েছে সেটি। তার নাম জেমস বন্ড। সে প্রায়ই তৃণভোজী বাচ্চাদের সাথে খেলা করে। এটি নিয়ে অবশ্য দু’পক্ষেরই মন কষাকষি।
সন্ধ্যা হয়েছে প্রায়, একটু পর সূর্যটা সামনের গাছ-গাছালিতে ঢাকা রহস্যময় জঙ্গল আর সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে যাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে ঘরে ফেরার একটা হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে। রাতের পোঁকাগুলো একটু পর কর্কশ শব্দ করে জানিয়ে দিবে আগাম রাতের উপস্থিতি। এখন অবশ্য প্রান্তর জুড়ে অদ্ভুত রকম নিস্তদ্ধতা বয়ে যাচ্ছে। গাছের ডালের সাথে পাতার মৃদু খসখস শব্দও বেশ জোড়ালো বলে মনে হচ্ছে। ডাইনোসরগুলো ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে গেছে। জঙ্গলটা তাই বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
হঠাৎ অদূর হতেই থপথপ শব্দ শোনা গেলো। মনে হচ্ছে বড় আকৃতির কোন প্রাণী এই ভর সন্ধ্যায় শিকার ধরতে বের হয়েছে। গাছের ডালে ডালে সেই শব্দ বাড়ি খেয়ে শিস বাজালে যেমন শব্দ হয়, তেমন মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে।
মাংসভোজী ডাইনোসর জেমস বন্ড এসে দাঁড়িয়েছে জঙ্গলের মাঝামাঝি এই খোলা প্রান্তরটায়। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে সামনের দুই পা এমনভাবে উপরে তুলে দিয়েছে যাতে মনে হচ্ছে বিশাল আকৃতির একজন মানুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মাঝে। জেমস বন্ডের মাথাটা অন্যান্য ডাইনোসরদের মত চৌকোনা বা লম্বামত হয়নি, বরং কেমন একটা সৌন্দর্য্যতায় ভরা মুখায়ব পেয়েছে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সে মৃদু শব্দে তিনবার খোয়াক্ খোয়াক্ করে ডেকে উঠল। কয়েক মূহুর্ত পর আরেকটা ডাইনোসরের মূর্তি দেখা গেলো প্রান্তরের শেষ অংশে। সেটা একটা তৃণভোজী ডাইনোসর।
তৃণভোজীদের চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তারা হাঁটলে থপথপ শব্দটা মাটির সাথে মিশে যাবে। কিন্তু মাংসভোজীদের হাঁটার শব্দ বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া তৃণভোজীরা সাইজে মাংসভোজীদের চেয়ে খাটো। তারা মুখ হতে আগুণ বের করতে পারে না।
এই মূহুর্তে জেমস বন্ডের সামনে যে তৃণভোজী ডাইনোসরটা দাঁড়িয়ে আছে তার নাম পূর্ণিমা। দুইজনের বয়সই সবে সাতানব্বইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বয়সে ডাইনোসররা প্রেমে পড়ে। তবে ডাইনোসরবিদদের মতে তাদের প্রেমে পড়ার উপযুক্ত সময় হচ্ছে দেড়শ বছর বয়স।
জেমস বন্ড জানু পেতে বসার চেষ্টা করল। যতটা সম্ভব সে তার হৃদয়ের গভীরতা পূর্ণিমার সামনে মেলে ধরার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটির জন্য সে নিজ গোত্রের কারো সাথে খেলা-ধূলা করে না, শিকারে অংশগ্রহণ করে না। এমনকি সে মনে মনে ভেবে রেখেছে যে পূর্ণিমা যদি তার সাথে সম্পর্ক গড়তে রাজী হয়, তবে সে মাংস-ফাংস খাওয়া বন্ধ করে জঙ্গলের পাতা খাওয়া শুরু করবে। কিন্তু পূর্ণিমার আচরণে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সে কি রাজী হবে মাংসভোজী ডাইনোসরের সাথে প্রেম করতে? জেমস বন্ড পূর্ণিমার জন্য চোখ খোলা রেখে সব করতে পারবে। মেয়েটা বড্ড সুন্দর গড়নের হয়েছে। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। ভাগ্যিস তার মনের কথা পূর্ণিমার বাবা-মা কেউ বুঝতে পারে নি। তাহলে আর রক্ষা ছিল না। পিটিয়ে তার ছাল-বাকল দিয়ে ভোজন করে তারা হয়তো তৃণভোজী থেকে মাংসভোজীতে রূপান্তরিত হত।
জেমস বন্ড পূর্ণিমার মাথার দিকে তাকালো। গোলগাল অদ্ভুত মায়াবী এক ডাইনোসরের মুখ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ডাইনোসরটির চোখ জোড়া হতে দূর অচীন দেশের স্বপ্ন ভেসে আসছে। জেমস বন্ডের মনে হলো এই চোখ জোড়ার দিকে সে সারাজীবন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারবে। তেল চকচকে মসৃণ চামড়ার গাঢ় উজ্জল বর্ণ তার মনকেই শুধু দখল করেনি, তার চোখকেও ধাঁধিয়ে দিয়েছে। আচমকা তার মনে হলো পূর্ণিমা অবশ্যই তার জীবন সঙ্গি হবার জন্য রাজী হবে। তা নাহলে সে এখানেই মেয়েটির সামনে নিজের জীবন দিয়ে দিবে নিজের আগুন দিয়েই। পূর্ণিমা ঘড়ঘড় শব্দ করে জেমস বন্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
-আমাকে রাতের বেলা কেন ডেকেছো?
-সেটি কি তোমায় খুলে বলতে হবে? তোমার মনকে একবার জিজ্ঞ্যেস করে দেখো তো, আমার চোখের ভাষা কি বলে?
-আমি অতশত কাব্যিক কথা বুঝি না। তুমি জানো, আব্বু যদি টের পায় এই গভীর রাতে আমি জঙ্গলের নিরিবিলীতে একজন পর-ডাইনোসরের সঙ্গে কথা বলছি, তাও আবার একজন মাংসভোজীর সাথে! তাহলে আমাকে মেরে হয়তো হাতির মায়ের মত সাইজ করে ফেলবে।
-কেন বৃথা হেয়ালী করছ? তুমি ভালো করে জানো আমি নিজের গোত্রের সমস্ত বন্ধু আর মেয়েদের বাদ দিয়ে প্রতিদিন তোমাকে দেখতে আসি, তোমার গোত্রের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আসি। আমি কি কোনদিনও তোমার আব্বু কিংবা মুরুব্বী কোনো ডাইনোসরের সাথে বেয়াদবী করেছি? তুমি ভালো করে জানো আমার মনের কথা, একটু ভেবে দেখো, প্রেম-ভালোবাসা ডাইনোসররা কেন করে। নিশ্চয়ই মানুষের মত নেঙটো হয়ে কুকাম করার জন্য নয়। কারণ আমরাতো এমনিতেই সারাক্ষণ নেঙটো হয়ে থাকি।
জেমস বন্ডের কথা শুনে পূর্ণিমা হাসতে হাসতে মাথা নিচু করে ফেলল। জেমস বন্ড অবাক হয়ে তাকালো। একজন ডাইনোসর এতো সুন্দর ভঙ্গিতে হাসতে পারে তার ধারণার বাইরে ছিল। সে তার কন্ঠের সমস্ত আবেগ একত্রে আনার চেষ্টা করল। সে জানে পূর্ণিমা নামের ডাইনোসরটিকে তার জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সে ব্যাকুল কন্ঠে আবার কথা বলে উঠে।
-আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস কর পূর্ণিমা, আমি কোনদিন তোমাকে কষ্ট দিব না। আমি জানি এই দাবী অন্যায়, কারণ এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের কখনো মিল হয় না। কিন্তু তুমি কি জানো যে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে রাজী আছি? তুমি আমার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে ফেলেছো। এখন আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এগুলো আমার একদম মনের কথা। তুমি কি ভাবছ জানি না, তবে আমি শুধু তোমার জন্যই নিজেকে এগিয়ে নিতে চাই।
পূর্ণিমা জেমস বন্ডের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। মূলত সে আগে হতেই পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু এখানে তার আগ্রহ থাকলেও কিছু করার নেই। সে জানে এটি কোনদিনই সম্ভব নয়। কারণ উভয় পক্ষেরই বংশগত অনেক বাঁধা-নিষেধ আছে। তাছাড়া তৃণভোজী আর মাংসভোজীদের মধ্যে মিল জঙ্গলের কেউ মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। ব্যাপারটা সে জেমসকে বোঝাতে চাইলো।
-দেখো জেমস, আবেগ থাকা ভালো- কিন্তু যেখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই সেখানে বৃথা আবেগ দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। তুমি ভালো করে জানো যে আমাদের সম্পর্ক কোনদিনও বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে না। তোমার বাবা-মা সবসময় তোমার ভালো চাইবেন। দেখো, উনি বোধহয় তোমার জন্য তোমার গোত্রের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটিকে বেছে রেখেছেন। তুমি মনে হয় আমার কথাতে কষ্ট পেতে পারো, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। সমাজের বিধি-নিষেধের কাছে আমাদের হাত-পা বাঁধা। তোমাকে আমি এমনিতে পছন্দ করি, কারণ তুমি তোমার গোত্রের অন্যান্য মাংসভোজী ডাইনোসরদের মত উগ্র নও। এবং সত্যি বলতে কি, তোমার চেহারাও যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু আমার মনে হয় আমি তোমার জন্য না। তাছাড়া আমার বয়স একশ হলেই বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবেন। বিয়ের পাত্র এখন থেকে ঠিক করা আছে। আমাদের গোত্রের কুদ্দুস আঙ্কেলের ছেলে ফেরদৌসের সঙ্গে। আমি বন্ধু হিসেবে তোমাকে অনুরোধ করব, তুমি দয়া করে আমাকে এ ধরণের অসম্ভব কিছু করতে বোলো না। আমি সত্যিই তোমার ভালো চাই।
একটানা কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেলো পূর্ণিমা। তার এখন ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন যেন সে নড়তে পারছে না। তার কথাগুলো কি খুব লেগেছে জেমসের মনে? ছেলেটার মুখ কেমন যেন অসহায়ের মত ধারণ করেছে। তার খুব ইচ্ছে করছে জেমসকে কিছুক্ষণ শান্তনা দিতে। কিন্তু সে নিরুপায়। জেমস বন্ড গভীর চোখে পূর্ণিমার চোখের দিকে তাকালো। আঁধো আলো আর আঁধো ছায়াতে তাদের দু’জনকে একটি বাগানের দুটি লতা গাছ বলে ভ্রুম হচ্ছে।
-পূর্ণিমা, তুমি কি কখনো কারো চোখে স্বপ্ন তৈরি হতে দেখেছো? স্বপ্ন তৈরি হওয়ার সময় মনের মানুষ যদি পাশে না থাকে, তাহলে কিন্তু সেই স্বপ্ন ক্ষয় হওয়া পাথরের মত ঝরে পড়ে যায়। আমি তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আমি মনে করি আমার ভালোবাসার জন্য পৃথিবীতে যত বাঁধাই আসুক, সব আমি দমন করতে পারব। আর সমাজের বিধি-নিষেধ মেনে ভালোবাসা তৈরি হয় না, ভালোবাসা তৈরি হয় দুইজনের মনের ইচ্ছায়। তুমি কি মনে করো না যে আমার মনে সেই পরিমাণ ইচ্ছা আছে?
-আসলে ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ না জেমস।
ঘাড় নাড়িয়ে বলে উঠে পূর্ণিমা। জেমস ব্যাকুল হয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তার মনটা বোধহয় এখুনি ভেঙ্গে যাবে। সে কি করতে পারে এখন?
-পূর্ণিমা, বিশ্বাস থেকে ভালোবাসা তৈরি হয়। একবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখো না, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি ঠকবে না। সারাজীবন তোমাকে আমি আগলে রাখব। একবার আমার চোখের দিকে তাকাও, আমার হৃদয়ের ভাষা তোমাকে বলতে পারছি না। দেখো না আমার চোখের দিকে। তোমার লেজে হাত দিয়ে বলো তো, তুমি কি মনে মনে একটুও চাও না আমায়?
পূর্ণিমার প্রচন্ড ভয় লাগছে। আকাশ ভরা তারা দেখা যাচ্ছে। তারাদের মাঝখানে চাঁদটা কি সুন্দর প্রান্তরের মাঝখানটা আলোময় করে তুলেছে! সেই দৃশ্য দেখলে দেহে কিরকম এক শিহরণ লাগে। যেন অদৃশ্য কোনো তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে দেহের ভিতরের শিরা দিয়ে। জঙ্গলের কালো কালো অন্ধকার ভাব দূর হয়ে চাঁদের আলোর প্রলেপ পড়ছে গাছের ছায়ার ভিতরে। দূরের গাছগুলিকে মনে হচ্ছে ছায়াময় একদল প্রহরী। হঠাৎ করে পূর্ণিমার মনে হলো তাদেরকে নীরবে পাহাড়া দেয়ার জন্য গাছগুলো দূরে সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তার এতো অদ্ভুত সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে কেন? এরকম অনুভূতি তো সে তার জীবনে এতটা বছর কখনো পায়নি। মনে হচ্ছে নতুন কিছু ফুল আর পাখি অদ্ভুত আশ্চর্য এক বাগানে মহানন্দে খেলা করছে। পূর্ণিমার আচমকা ঝরঝর করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। তার বুকের মাঝখানটায় কিসের যেন এক শূণ্যতা। সে ধীরে ধীরে মাথা উঁচিয়ে তাকালো জেমসের চোখে। সেখানে প্রচন্ড আবেগের এক স্বপ্ন দেখতে পেলো সে। তার মনে হলো এই চোখের দৃষ্টির জোড়ে পৃথিবী সমস্ত সামাজিকতার নামে রচিত শৃঙ্খলা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো পূর্ণিমা। সে জেমসের ঘাড়ে নিজের মাথা এলিয়ে দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। এই কান্না কষ্টের না, কেমন যেন বিষাদ মাখা আনন্দের। চোখের জলের প্রতি ফোটায় ফোটায় আনন্দ উপচে পড়ছে।
জেমস এই কান্ডের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার ধারণা ছিল মেয়েটি হয়তো কঠোরভাবেই তাকে নিবৃত করবে। পূর্ণিমা এখন কাঁদছে তার ঘাড়ে-বুকে নিজের দেহ স্পর্শ করে। জেমসের মনে কিসের যেন তীক্ষ্ণ একটা সুখের ছোঁয়া বয়ে গেলো। পূর্ণিমার চোখের পানিকে সে সামনের পা দুটি দিয়ে যথেষ্ট কসরত করে মুছে দিলো।
চাঁদটা এই মূহুর্তে নিরব আকাশের সমস্ত সীমানায় স্বপ্নময় আবেগের জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের মাঝের পুরো প্রান্তর সেই আলোর দেখা পেয়ে আজ জেগে উঠেছে। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তদ্ধতাপূর্ণ নিবিড় এক উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কেমন যেন জীবন্ত জীবন্ত প্রকৃতি নেমে এসেছে সমস্ত প্রান্তর জুড়ে। জেমসের মনে হলো তাদের দু’জনের জন্যই বোধহয় আজ প্রকৃতি এতো আয়োজন করেছে।
দূরে আকাশের এক কোণে একটা তারা মিটিমিটি করছে। জেমসের মনে হয় সেটি তাদের সাথে একত্রে বন্ধুত্ব করতে এসেছে।
তিনমাস পরঃ শেষ বিকেল। জেমস আর পূর্ণিমা বসে আছে জঙ্গলের মাঝামাঝি সেই খালটার কিনারে। সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে, যেকোনো মূহুর্তে ডুবে যাবে। খালের পানি এখন ভরা জোয়ারের টানে বেড়ে চলছে। আজ যদি পূর্ণিমা হয়, তবে ভরা কাটাল হবার সম্ভাবনা আছে।
জেমস এক দৃষ্টিতে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পূর্ণিমার চোখে দুষ্ট দুষ্ট ভাব। সে সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে বসে আছে। মাঝে মাঝেই লেজের ঝাপটা দিয়ে পানিতে ঢেউ তুলছে সে। জেমস নিজের কাটাযুক্ত লেজটি গুটিয়ে রেখেছে তার পিঠের নিচে। তার মন কিছুটা খারাপ। কিছুক্ষণ আগে পূর্ণিমা তাকে বলেছে যে সে নাকি জেমসের সাথে শুধু প্রেম করবে। বিয়ে করবে না। পূর্ণিমা হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললো। তৃণভোজী ডাইনোসররা হাসলে মুখের অগ্রভাগের চামড়া প্রসারিত হয়ে খুব সুন্দরমত আকৃতি হয়, আর পূর্ণিমারতো কথাই নেই। জেমস মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তার প্রিয়তমার দিকে।
-তুমি বৃথা চিন্তা করছ কেন? যখন বিয়ের সময় আসবে তখন দেখা যাবে আমরা কি করব।
মানুষের মত ডাইনোসররা ভ্রু কুঁচকানোর বদলে নাক কুঁচকায়। জেমস নাক কুঁচকিয়ে প্রশ্ন করল।
-তখন কি দেখা যাবে?
-আমার প্রভা নামে এক বান্ধবী আছে, সে প্রেম করেছে সালমানের সঙ্গে, আর বিয়ে করেছে শাকিব খানের সঙ্গে।
-এই কথা আমাকে শোনাচ্ছ কেন?
কৃত্রিম রাগাম্বিতভাবে প্রশ্ন করল জেমস বন্ড। জেমসের রাগ দেখে মজা পাচ্ছে পূর্ণিমা। ছেলেটা অনেকটা বাচ্চা বাচ্চা মার্কা স্বভাব পেয়েছে। অন্যান্য মাংসভোজী ডাইনোসরদের মত রাক্ষস মার্কা বা হিংস্র স্বভাব পায়নি। ছেলেমানুষি দেখতেও বেশ ভালো লাগছে পূর্ণিমার।
-এই কথা তোমাকে শোনাচ্ছি, কারণ আমি ঠিক করেছি আমিও আমার বান্ধবীর মত প্রেম করব একজনের সাথে, শেষে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব অন্যজনের সাথে। কেমন হবে বলো তো?
পূর্ণিমার মুখে মুচকী হাসি। জেমস গম্ভীর হয়ে গেলো। তার মনটা কেন জানি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটার সামনে সে স্বাভাবিক হতে পারে না। ডাইনোসরটা কি তাকে প্রেমের জাদু করেছে? এত ভালোবাসতে ইচ্ছে করে কেন তার? সে কি পূর্ণিমার মত স্বাভাবিকভাবে টিটকারী করে কথা বলতে পারে না? পূর্ণিমা জেমসের অবস্থা দেখে ক্রমাগত হেসে চলছে। জেমসকে রাগিয়ে দিতে যেয়ে যে মন খারাপ করিয়ে ফেলেছে তা বুঝতে পারেনি সে। আচমকা এমন কান্ড করে বসল জেমস যে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না পূর্ণিমা। ভ্যাক ভ্যাক করে কেঁদে-কেটে কেমন যেন মিইয়ে গেলো জেমস। পূর্ণিমা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
-কি ব্যাপার, তুমি কাঁদছ কেন?
-তোমার তো আমাকে কোনো দরকার নেই। যাও না, যাকে বিয়ে করবে তার কাছেই যাও। আমার কাছে কি মরতে এসেছো নাকি?
বলে ঝরঝর করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ঝরিয়ে ফেলল জেমস। মেয়ে জাতীগুলো কি এভাবেই শুধু পুরুষদের কাঁদাতে চায়? পূর্ণিমার মনটা জেমসের জন্য আবেগে গলে এলো। ছেলেটা তাকে বিক্ষুদ্ধ ঝঞ্ঝার মত ভালোবাসে। এ কারণে সামান্য কথাতেই আপসেট হয়ে পড়েছে। সে গভীর আবেগে জেমসকে জড়িয়ে ধরে। তারপর নিজেও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
-আমি অত্যন্ত দুঃখিত প্রিয়া, দয়া করে তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি শুধু তোমার জন্যই। তুমি কি দুষ্টুমীও ধরতে পারো না? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি জেমস। বিশ্বাস কর, অনেক ভালোবাসি। আমি জানি তুমি খুব ভালো, আচ্ছা তুমিই বলো, তুমি যদি ভালো না হতে তবে কি আমি তোমার সাথে সম্পর্ক গড়তাম? তুমি মিছে কেন কষ্ট পেলে বলো তো প্রিয়া? এখন তো আমারও ভালো লাগছে না।
বলে পূর্ণিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে জেমসের চোখের পানি মুছে দিতে লাগল। জেমস ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তার নিজের কাছে কেন জানি লজ্জা লাগছে। কান্না না করলে কি হতো? পূর্ণিমার এখন মন খারাপ হয়ে গেছে। সে কি গাধা! প্রিয় মানুষের দুষ্টুমীও ধরতে পারে না! এর চেয়ে লজ্জার কথা আর কি আছে? দু’জন হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা একেবারে চুপ হয়ে থাকে। তার কারণ তখন তাদের কথা বলার দরকার হয় না। তখন কথা বলে চারপাশের প্রকৃতি। গাছপালা শিরশির শব্দে কথা বলে, খালের পানি ছল ছল শব্দে মৃদু ঢেউ তুলে, সূর্যটাও যেন লজ্জা পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে আড়াল হয়ে যায়। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রেখে টের পায় না কখন সন্ধ্যা হয়েছে।
পরদিন বিকেল বেলা পূর্ণিমা খালের পাড় হতে পানি খেয়ে বাসায় ফিরছিল। জঙ্গলের ভিতর ঢুকার জন্য প্রান্তরের পাশ দিয়ে বড় একটা স্বচ্ছ জায়গা ছিল। সেখানের পুরোটা পথ জুড়েই তাদের গোত্রের একটা তৃণভোজী ডাইনোসর হুমায়ূন ফরিদি দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ণিমা প্রথমে ভেবেছিল ফরিদি বুঝি কোন কাজে এসেছে। কিন্তু যখন পূর্ণিমা ফরিদিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল তখন পূর্ণিমার সামনে এসে তার যাওয়ার পথ বন্ধ করে দাঁড়াল হুমায়ূন ফরিদি। পূর্ণিমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো ব্যাপার দেখে।
-ব্যাপার কি ফরিদি ভাই? আপনি এভাবে আমার যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে রেখেছেন কেন?
-হেহঃ হেহঃ, রাস্তা বন্ধ করলাম কই, আমি তো শুধু তোমার সাথে কিছু কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আর আমাকে ভাই বলে ডাকছ কেন? নাম ধরে ডাকলে কি অসুবিধা?
-আপনি ভালো করে জানেন যে আমি এমন কোন বেয়াদব মেয়ে না যে যাকে তাকে নাম ধরে ডাকব।
পূর্ণিমার কথা শুনে খোয়াক্ খোয়াক্ করে ডেকেই প্রচন্ড বেগে লেজ নেড়ে হাসতে লাগল হুমায়ূন ফরিদি। যেন এই ধরণের কথাই সে আশা করছিল। শয়তানী ভঙ্গিতে মাথা বাঁকিয়ে সে বলতে লাগল।
-আমি জানি, তুমি খুবই ভালো প্রকৃতির মেয়ে, সেজন্যই তো তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে। এখন কিছু কথা বলব, মনোযোগ দিয়ে শুনবে। জেমস বন্ড তোমার কি হয়?
-আমি তাকে ভালোবাসি।
স্পষ্ট সুরে জবাব দিল পূর্ণিমা। জবাব শুনে সবজান্তার মত উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালো হুমায়ূন ফরিদি।
-এগুলো মোটেই ঠিক না, তুমি কি তোমার জাত বিসর্জন দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছো?
-শুনুন ফরিদি ভাই, আমার মনে হয় আপনি পুরো ব্যাপারটাই ভালো করে জানেন। তাই আপনাকে বলে রাখছি, তৃণভোজী আর মাংসভোজী ডাইনোসররা হয়তো আলাদাভাবে বাস করছে, কিন্তু তাদের দেহের গঠন আর গোত্রের শৃঙ্খলা একই রকম। কাজেই কারো প্রেম দেখে হিংসা পেয়ে মিছেমিছি জাতিগত বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা করবেন না।
হুমায়ূন ফরিদি আবারও একটা লেজ নাড়িয়ে অদ্ভুত শীতল হাসি দিল।
-আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় যে আমরা জাতিগত প্রভেদ মিছেমিছি তৈরি করেছি? এর পিছনে অনেক কারণ আছে। তোমার ভালোর জন্য বলছি, তুমি মাংসভোজীদের পথ হতে সরে যাও। আমি তোমাকে ছোট বেলা হতে পছন্দ করি, আর তুমি কিনা কোথাকার এক মাংসভোজী ডাইনোসরকে পছন্দ করে বসে আছো। যা হবার হয়েছে, তুমি ওকে ভুলে যাও। তুমি আমাকে বিয়ে করবে।
-হুহ! আপনার মাথা খারাপ হতে পারে, আমার মাথা এখনো ঠিক আছে। আপনার মত নিচু প্রকৃতির ভন্ড প্রতারক ডাইনোসরকে আমি কেন, কোন পাগলীও বিয়ে করবে কিনা সন্দেহ আছে।
বেশ ক্ষোভের সাথে জবাব দিল পূর্ণিমা। এই প্রথম হুমায়ূন ফরিদির মুখে অপমানের ছায়া দেখা গেল।
-বেশ, তুমি যদি মাংসভোজী ওই ভূতটাকে বিয়ে কর, তাহলে করতে পারো। কিন্তু প্রথম রাতেই সে তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করবে তা আমি তৃণভোজী হয়ে কি করে সহ্য করব বলো তো?
-কি বললেন আপনি? সে আমাকে খুন করবে কেন?
ঘাড়টা সামান্য বায়ে কাঁত করে ফরিদি বোঝাতে লাগল ব্যাপারটা।
-একটা পারসোনাল প্রশ্ন করি, তোমরা কি এখন পর্যন্ত কিস (চুমু) করেছো?
-জ্বি না, আমাদের বিয়ের পূর্বে এমন কিছু করার চিন্তা-ভাবনা নেই।
-বেশ, তোমরা কখনো একজন আরেকজনকে চুমু দিতে পারবে না। কারণ জেমস হলো মাংসভোজী ডাইনোসর। ওর মুখ সব সময় আগুনের মত গরম থাকবে। চুমু দিতে গেলে তোমার ঠোট-মুখ পুড়ে যাবে।
পূর্ণিমা চোখ রগড়িয়ে তাকালো ফরিদির দিকে।
-আমাদের কিস করার কোনো প্রয়োজন নেই।
বলে গটগট করে হেঁটে চলে যেতে নিচ্ছিল পূর্ণিমা। ফরিদি তার নিচের দু’পা বাড়িয়ে দিলো পূর্ণিমার গতিরোধ করার জন্য। বাঁধা পেয়ে পূর্ণিমা হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা বিশাল বট গাছের গোড়ায়। পরমূহুর্তে ফরিদি জোর করে পূর্ণিমার গায়ে ঝাপিয়ে পড়ল। তারপর আচমকা নিজের উত্তেজিত অঙ্গটা খাড়া করিয়ে সরাৎ করে ভরে দিতে চাইলো পূর্ণিমার গোপন অঙ্গে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল পূর্ণিমা। ফরিদি ততক্ষণে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করছে নিজের কুমতলব চরিতার্থ করার। এর মধ্যে হঠাৎ করে কোথা হতে যেন জেমস বন্ড এসে হাজির হল। সে এসেই প্রথমে তার কাটাওয়ালা লেজ দিয়ে তুমুল জোরে আঘাত করল হুমায়ূন ফরিদির বুক বরাবর।
গোঁ গোঁ করে নিজের বুক চেপে ধরে শুয়ে পড়ল ফরিদি। জেমস কোনো সুযোগ দিল না, শুয়ে পড়া অবস্থায় নিজের বিশাল দুটি পা দিয়ে একযোগে আঘাত করল ফরিদির মেরুদন্ডে। বাবা গো বলে ফরিদি ফুটবলের মত গড়িয়ে গেলো।
নায়কের পার্ট নিয়ে দু’পা ছড়িয়ে পূর্ণিমার সামনে দাঁড়ালো জেমস বন্ড।
এতো কিছুর মধ্যে দু’জনের খেয়ালই রইল না কখন তাদের প্রেমের গোপন খবর তাদের বাবা-মায়েরা জেনে গেছে। হঠাৎ জেমসের মাথায় কিসের যেন তীব্র আঘাত পড়ে। সে পাশ ফিরে তাকানোর আগেই তার চোয়াল প্রচন্ড ব্যাথায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। ওদিকে পূর্ণিমাও চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। চটাশ করে চাটি পড়ল পূর্ণিমার চোয়ালে। তারপর বেদমভাবে জেমসকে পিটাতে লাগল পূর্ণিমার বাবা নাসিরুদ্দিন শাহ। জেমসের হুশ জ্ঞান আগেই হারিয়ে গেছে। এরপর যা মার সে খেল তার পুরোটাই তার অচেতন অবস্থায়। মাথার তীব্র আঘাতেই তার জ্ঞান হারিয়েছে।
পরদিন সকাল বেলা।
বিচার বসেছে জঙ্গলের খোলা প্রান্তরটায়, যেখানে জেমস আর পূর্ণিমা তাদের মনের ভিতর জমানো গোপন কথা বলার জন্য মিলিত হত। সেই একই জায়গা, একই গাছপালা, একই খাল- কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। জেমসকে ধরে রাখা হয়েছে পূর্ণিমার বাবার পাশে। সে পাশে তৃণভোজী ডাইনোসরদের সারি। বিপরীত দিকে মাংসভোজী ডাইনোসরদের বিশাল সারি। দু’পক্ষেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো মূহুর্তে মাংসভোজী ডাইনোসরদের মুখ হতে ফক্কশ ফক্কশ শব্দের সাথে আগুন বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া তাদের কাটাযুক্ত লেজগুলোও যেন যুদ্ধের অশনি সংকেতের অপেক্ষায় আছে।
পূর্ণিমার বাবা কথা বলে উঠল জেমস বন্ডের বাবার দিকে চেয়ে।
-আপনার ছেলে জেমস কি অপরাধ করেছে দেখতেই পাচ্ছেন মিস্টার ডি ক্যাপ্রিও! আশা করি তার একটা ব্যবস্থাও আপনি এখুনি করে ফেলতে আমাদেরকে সাহায্য করবেন।
খানিকটা ব্যাঙ্গ করেই বলল পূর্ণিমার বাবা নাসিরুদ্দিন শাহ। ডি ক্যাপ্রিও মৃদু ঘড়ঘড় করে উঠল।
-শুনুন মিস্টার নাসির মোল্লাহ! এক হাতে তালি বাজে না, এই বিখ্যাত প্রাচীন কথাটি আশা করি আপনাকে নতুন করে শিখিয়ে দিতে হবে না। আপনি ভালো করেই জানেন যে আপনার মেয়ে এই কাজে উস্কানী দিয়েছে বলেই আজ এ অনাকাঙ্খিত সম্পর্কটি ঘটেছে। আমার ছেলের ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছি, কিন্তু আপনার মেয়ের জন্য আপনি কি ব্যবস্থা নিবেন শুনলে বড় উপকৃত হতাম।
নাসিরুদ্দিন শাহ খোয়াক্ খোয়াক্ শব্দ করে ডেকে উঠল। তার মাথা আজকে যথেষ্ট উত্তেজিত অবস্থায় আছে। সে এ ঘটনার এফোঁড়-ওফোঁড় করে ছাড়বে।
-খামোশ মিস্টার ক্যাপ্রি! আমার মেয়ে কি আপনাদের এলাকায় গিয়ে আপনার বাদাইম্যা ছেলের সাথে প্রেম করেছে? নাকি আপনাদের এলাকায় গিয়ে আপনার গুণধর সুযোগ্য সুপুত্রের সঙ্গ পীরিতের আলাপ করার বায়না ধরেছে? আপনার ছেলে লুচ্চা কমিটির সভাপতি হওয়ায় সে এসেছে আমাদের এলাকাতে, তাও আবার প্রেম করতে আমার মেয়ের সাথে! তার মাথার ঘিলুর প্রশংসা করতে হয়।
ডি ক্যাপ্রিও আরো কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় তার ছেলে জেমস বন্ড চেঁচিয়ে উঠল।
-বাবা, তোমরা বৃথা ঝগড়া করছ কেন? আমরা একে অপরকে পছন্দ করি। এই দোষ আমাদের, কেন তোমরা নিজেরাই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছো? মেনে নাও না এই সম্পর্ক।
অনুরোধ করে জেমস। সাথে সাথে দুই পক্ষে তীব্র চাপা গুঞ্জন শোনা যায়। ডি ক্যাপ্রিও
নিজের ছেলেকে বলে উঠে,
-এই ব্যাটা ছাগলের বাচ্চা জেমস! তুই এত সুন্দরী সব মায়াবী মাংসাসী ডাইনোসর থাকতে কিনা গিয়েছিস তৃণভোজী নরম কাটাওয়ালাদের কাছে। তোর মাথায় ঠাডা পড়ুক। তোর আক্কেল কি হবে নারে? তুই বেক্কলের মত এসব কি বলছিস?
-বাবা, কেন মিছেমিছি জাতিগত প্রভেদ তৈরি করছ? আমরা এখানে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমরা জোর করে কি আমাদের রোধ করতে পারবে? ভেবে দেখো, আজ যদি আমাদের জায়গায় তোমরা হতে, তাহলে তো তোমরা নিজেদের প্রেমকে সার্থক করার জন্যই উঠে পড়ে লাগতে। এখন আমাদের বাঁধা দিচ্ছো কেন?
এই পর্যায়ে ধমকে উঠল পূর্ণিমার বাবা নাসিরুদ্দিন শাহ।
-চুপ কর বেটা ছাগলের বাচ্চা গরুর সন্তান! তোর বাপ যেটি বলেছে সেটি বোঝার মত গোবর এখনো তোর মাথায় হয়নি, আর হবেও না। তুই মর নিজের গর্তের ভিতর!
পূর্ণিমা ঠিক তখনই চেঁচিয়ে উঠল,
-বাবা, তুমি এসব কি বলছ? আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসার মধ্যে তুমি যে কথা বলছ তার কোন ভিত্তি নেই। কারণ আমরা উভয়ে একই প্রজাতী, সবাই ডাইনোসর। তাহলে কেনো সব বিভেদ ভুলে ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছ না? এতে কি ভালো কিছু হচ্ছে?
পূর্ণিমার বাবা মেয়েকে ভেঙচে উঠল সুর করে করে।
-ওরে আমার জ্ঞানী মেয়েরে! জ্ঞান কয় লিটার হয়েছে? চোঙ দিয়ে মেপে দেখতে হবে নাকি? লাজ-লজ্জার মাথা যখন খেয়েছিস, তখন একটা কথা বলি। বিয়ের পর ওই ছাগলের বাচ্চা গরুর সন্তানটাকে চুমু দিবি কিভাবে? পাছা দিয়ে?
-কেন বাবা? এর মধ্যে চুমুর প্রশ্ন আসছে কেন?
-ওরে আমার জ্ঞানী মেয়েরে! ওই ব্যাটা হলো মাংসভোজী, ওরা ফক্কশ ফক্কশ শব্দ করলে মুখ হতে আগুন বের হয়, তুই সেই মুখে চুমা দিয়ে সাত-আট দিনের মধ্যেই নিজের চেহারা বিশ্বসুন্দরীর মত কয়লা করে ফেলতে চাস নাকি?
-কয়লা হলে চুমু দিব না। শুধু নিচেরটুকু করব।
গম্ভীর মুখে দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল পূর্ণিমা। তবে তাতে পূর্ণিমার বাবা মোটেও দমল না।
-ওরে আমার শখ রে! ওই বদমাশ মাংসভোজীর লিঙ্গে লেজের মত কাটা আছে সেটি কি তুই জানিস না? না জানলে জেনে নে, ও যখন লিঙ্গ তোর ওখানে ঢুকাবে। তখন তোর ওইটা ঝড়ের মুখে পড়া গাছের পাতার মত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তুই তো নিজের মরণ নিজেই ডেকে আনতে চাইছিস, এই জন্যই বলছি তোকে গাধীরাম কোথাকার!
এ সময় জেমস অভূতপূর্ব এক জবাব দিল।
-গোপন সম্পর্কের কথা যখন তুললেন, তখন একটা কথা বলছি। আমাদের গোপন সম্পর্কটা জরুরী বিষয় নয়, জরুরী বিষয় হলো আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। সারাজীবন ভালোবেসে যাব। তার জন্য যে আমাদের গোপন সম্পর্ক গড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই। আপনারা শুধু শুধু আমাদের দু’জনের পবিত্র সম্পর্ক ধ্বংস করতে যাবেন না।
ডায়ালগ শুনে পূর্ণিমার বাবা নাসিরুদ্দিন শাহ হাতের একটি গাছ নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল জেমস বন্ডের গায়ে। তীব্র বেগে গাছটি এসে আঘাত করল জেমসের কাঁধের মাঝ বরাবর। তৎক্ষণাৎ চামড়া ছিলে রক্তের ধারা বয়ে যেতে শুরু করল জেমসের দেহ হতে। ব্যাপার দেখে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল মাংসভোজী ডাইনোসরদের দল। এরপর জেমসের বাবা ডি ক্যাপ্রিও তার মুখ হতে ফক্কশ শব্দ তুলে আগুনের দলা বের করলেন পূর্ণিমার মাথা লক্ষ্য করে। একটা মূহুর্ত লাগল জেমসের ব্যাপারটা বুঝে উঠার জন্য। সে প্রচন্ড গতিতে পূর্ণিমাকে ধরে লাফিয়ে পড়ল শক্ত মাটিতে। আগুনের তীব্র আঁচ লেগে ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হলো জেমসের মাথা।
সাথে সাথে মারমার কাটকাট শুরু হয়ে গেলো উভয়পক্ষের ডাইনোসরদের মাঝে। জেমস যতক্ষণ চেতনা ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা করল ডাইনোসরদের এই অহেতুক যুদ্ধ থামাতে। কিন্তু সে পূর্ণিমাকেও সামলে রাখতে পারছে না। এরি মধ্যে পূর্ণিমার দেহে আঘাত লেগে চামড়া ফেড়ে গিয়ে ভরভরিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কোথা হতে আঘাত এসেছে দেখতেই পায়নি জেমস।
তীব্র আর্তনাদ আর করুণ কন্ঠের হাহাকার উঠছে ডাইনোসরদের মাঝে। একজন আরেকজনকে যেভাবে পারছে মারছে। জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত জেমস দেখতে পেলো ডাইনোসরগুলো একের পর এক লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি আর মৃত্যুর ঘন্টা ধ্বনি বেজে চলছে বুক ফাটানো স্বরে। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলল ডাইনোসরদের দু’পক্ষের খুনোখুনি। তারপর এক সময় নীরব হয়ে এলো চারপাশ। প্রান্তর জুড়ে অদ্ভুত নিস্তদ্ধতা আর নির্জনতার গাঢ় ছায়া পড়ল। গাছের পাতা কিংবা বনের অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের কন্ঠও যেন তীব্র ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
দুই দিন পরঃ জ্ঞান ফিরে এসেছে পূর্ণিমার। খানিকটা দ্বিধা আর ম্যাজম্যাজ ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল সে। প্রচন্ড জ্বালা করছে তার সারা দেহ জুড়ে। মনে হচ্ছে কোনো লোহার বল্লম দিয়ে তার শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। ধীরে ধীরে তার নাকে ভ্যাপসা পঁচামতন গন্ধটা এলো। চোখ মেলে তাকালো সে প্রান্তর জুড়ে। সেখানে সারি সারি ডাইনোসরদের মৃত দেহ পড়ে রয়েছে দেখে শিউড়ে উঠল সে। কি ভয়ানক দৃশ্য! একেকটার দেহ যেন ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিনা দ্বিধায় খুবলে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। কয়েকটা ডাইনোসরের আবার মাথা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। জায়গায় জায়গায় শুকনো মগজের দলা, বুকের খাঁচা আর পেটের নাড়ি-ভূড়ি পঁচে গিয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গন্ধে পূর্ণিমা নাকে হাতচাপা দিয়েই দুঃস্বপ্ন হতে বাঁচার জন্য দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল।
তারপর আবার চোখ খুলে তাকালো সে। তার গায়ের অনেক জায়গায় ক্ষতের চিহ্নু স্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে হেঁটে নিজেদের পুরানো উপত্যকার কাছে ফিরে এলো। সেখানে কেউ নেই। মনে হচ্ছে মাত্র দু’রাতের ব্যবধানে সমস্ত ডাইনোসর প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে। এসবের জন্য দায়ী তাদের উত্তাল প্রেম। সে কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবে? তাছাড়া তাদের প্রজাতী এত বোকা কেনো? সামান্য আক্কেলটাও কি তারা পায়নি?
প্রান্তরের একদম খোলা অংশে এসে দাঁড়ালো পূর্ণিমা। তার পেট হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠল। ঠিক প্রসব বেদনার মত ব্যাথা টের পেলো সে। প্রচন্ড কষ্টে তার মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে এলো। সে মাটিতে নুয়ে এলো। ঠিক তখনই তার পেট হতে যৌনাঙ্গ হতে দুটি ডিম বেরোল। একটি লাল রঙের, অন্যটি সবুজ রঙের। ঠিক যেন এক জোড়া মাংসভোজী আর তৃণভোজী ডাইনোসর খেলা করছে ডিমের ভিতর। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলো পূর্ণিমা। ধীরে ধীরে তার দু’চোখ অবসন্ন হয়ে এলো। প্রান্তরের মায়াময় মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল পূর্ণিমা। ধ্বংস হয়ে গেলো ডাইনোসরের বংশধর, একটি প্রেমের কারণে।
বর্তমানেঃ নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা। কয়েকজন প্রত্নতাত্নিক আফ্রিকার জঙ্গলের কাছের একটা সাগরের পাশে এসেছেন। সাগরের অন্যপাশে আবার একটা খাল চলে গেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। প্রত্নতাত্নিকরা একটা খোলা উপত্যকার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের হাতে নানারকম আধুনিক যন্ত্রপাতি আর চোখে কিসব অদ্ভুত কিসিমের কাঁচের গ্লাস। হঠাৎ একজন জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন। তিনি একজন বয়স্ক টিচার। হাতে তার হ্যান্ড গ্লাভস পড়া, সেখানে শোভা পাচ্ছে এক জোড়া শকুনের ডিমের মত অদ্ভুত রঙের ডিম। একটি লাল, অন্যটি সবুজ। মজার বিষয় হচ্ছে ডিমগুলো এখন পর্যন্ত ফেঁটে বা ভেঙে যায়নি। সম্পূর্ণ অক্ষতই আছে। আর মনে হচ্ছে সেখানে একজোড়া ডাইনোসর যেন জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে আসার জন্য।
Menu Bar
সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
শনিবার, ২০ মার্চ, ২০১০
ঢাকা শহরে এক দিনের ভ্রমন
বাসা
“আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই”
মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই জেগে উঠলাম আমি । সকাল ৭টা বাজে । মুখ ধুয়ে, নাস্তা খেয়ে বাংলাবাজার যেতে হবে । আমার উপন্যাস বের হবে কয়দিন পর । উপন্যাসের নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ ও ‘নাজু’ । কিন্তু সমস্যা হল আমার বাসা মিরপুরে, আর মিরপুর থেকে বাংলাবাজার যাওয়া মানে ঢাকা মেট্রপলিটন শহরের প্রায় পুরোটাই ঘুরে যাওয়া । আমি ছাত্র মানুষ, প্রথমদিকে উপন্যাস বের করার মত টাকা যোগাতে পারিনি ।
তাই বলে থেমে থাকিনি কিন্তু, বহুজন ও বহু প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করেছি ।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশের দৈনিক প্রথম আলো থেকে শুরু করে যত রকম ছোট-বড় পত্রিকা, ম্যাগাজিন রয়েছে তাদের অধিকাংশকেই বিরক্ত করেছি বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ই-মেইল পাঠিয়ে । এমন কি ব্যাঙ্ক,প্রাইভেট কোম্পানী, চ্যাট রুম, টিভি চ্যানেল এবং রেডিও চ্যানেলও বাদ রাখিনি ।
আমি সবার কাছে একটাই মেইল পাঠাতাম, তা হল এরকম-
Dear Sir,
I am Md.Arafat Hossain, student of Bashir Uddin Adarsha School & College in class-10. I am from Dhaka,Mirpur-1. By the way, I am a writer & I have written some proletereiet novel, such as- “ Meghna Nodir Tire, Narir Kanna, Jiboner Ontorale etc. But I have no capital to publish this novel. Please help me to publish my novel. Your help can be climbed me in the top position in the socity, specially in the literery world. You can contact with me at this number.
Mobile: 01671-856966
মোটামুটি এই ধরনের মেইল পাঠাতাম সকলকে । আর এই মেইল পাঠিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী বিরক্ত করেছি দৈনিক প্রথম আলো-কে । ফলশ্রুতিতে তাদের অফিস থেকে দুই/তিনবার বাসায় ফোন করে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে ।
যাই হোক, এজন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট হতে ক্ষমা প্রার্থী ।
তো, উপন্যাস বের করার জন্য আমি প্রকাশক সাহেবকে পাক্কা পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি । আর সবচেয়ে আজব বেপার হল, আমি গিয়েছিলাম আমার এক পরিচিত লেখক সাগর আঙ্কেলের সাথে । পরে জানতে পারলাম উনি আমার দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক হাজার টাকা দালালী খেয়েছেন । একথা জেনেছি আমি প্রকাশক সাহেবের কাছ থেকে ।
মোট কথা, জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম যে উপন্যাস ছাপাতে গেলেও দালালী খাওয়া হয় ।
আসল কথায় আসি এবার । নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম বাংলাবাজার যাওয়ার জন্য ।
মাকে বললাম- আম্মু, পঞ্চাশটা টাকা দাওতো, বাংলাবাজার যাব ।
-বাংলাবাজার যেয়ে যেয়ে তুই এ পযর্ন্ত কত টাকা খরচ করেছিস হিসাব আছে ? উপন্যাস ছাপিয়ে করবি টা কি শুনিতো ? সংসারে এত অভাব কি তুই চোখে দেখিস না ? এক কেজি করে চাল আনি, মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে হলুদ-মরিচ আনি । এতো অভাব চোখে দেখেও তুই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেছিস উপন্যাস বের করতে । আরে বাংলাদেশে কি লেখকের অভাব আছে ? তারাও তোর মত আশায় আছে উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হবে । কয়জন সফল হয়েছে দেখাতে পারবি ?
একটানা ক্ষোভের সাথে মা কথাগুলো বলে গেলেন । আমার দুঃখে বুক ফেটে কান্না বের হতে চাইল । আল্লাহ আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বানিয়েছেন । আমদের মত মানুষ সমাজে না পারে টাকার অভাবে নিচু কোন কাজ করতে, না পারে টাকার অভাবে কোন সচ্ছল ব্যবসা করতে । আমাদের এ পাশ কিংবা ও পাশ হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই । কারন মধ্যবিত্ত বলে আমরা একই সাথে সমাজের সকলের সাথে চলাফেরা করি । তাইত মান-সম্মান আর ইজ্জতের মুল্য আমরাই বেশী বুঝি ।
আমি মনে মনে বললাম-দেখো মা, তোমার ছেলে ঠিকই একদিন উপন্যাস লিখে খ্যাতির দোড়গোঁড়ায় পৌছে যাবে । মুখে বললাম- দাও না আম্মু, পঞ্চাশ টাকাই তো । আর মাত্র দুইবার যাব । তারপর উপন্যাস বের হয়ে যাবে, প্লিজ দাও ।
মা কিছু বললেন না, বেরিয়ে গেলেন । আমি জানি, এই পঞ্চাশ টাকা মা পাশের ঘরের সানির মার থেকে ধার করে আনবেন । মা তো মা ই, তাই এত কথার পরও আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলেন, আর বললেন- রাস্তাঘাটে সাবধানে যাস ।
-ঠিক আছে আম্মু, বলে ঘর হতে বেরিয়ে এলাম আমি । আমরা যে ফ্লাটটায় থাকি সেখানে মোট চারটি রুম । এক রুমে সানীরা, আর এক রুমে গামের্ন্টসে চাকরি করা স্বামী-স্ত্রী, আর একটায় ফ্লাটের মালিকের দোকানের কমর্চারী এবং আর একটায় আমরা থাকি ।
আমি এখন নিজের বুঝ বুঝি । এখনত আর বাবা-মার সাথে এক ঘরে, এক খাটে শোয়া যায় না । তাই আমার মা কর্মচারীদের খাটের পাশে আরেকটা পুরোন খাট ফেলেছে বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে । তবে এজন্য মাসে ছয়শ টাকা দিতে হবে । সকালে বাড়িওয়ালার কর্মচারীরা দোকানে যায়, আসে রাত এগারটায় । এর মাঝে আমি অবসর কাটাই সেই খালি রুমে । রচনা করতে চেষ্টা করি সাহিত্যগাথা, উপন্যাস, ছোট গল্প কিংবা কবিতা ।
মিরপুর-১
বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর-১ এর বাস স্ট্যান্ডে আসতে আমার অনেক সময় লাগল । এর কারণ হল প্রচন্ড জ্যাম ।
না, এই জ্যাম কোন যানবাহনের নয় ।
এ জ্যাম মানুষের জ্যাম ।
ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে হতে শুরু করে রাজপথ পযর্ন্ত সবর্ত্রই তাদের চলাফেরা,
তারা হল গামের্ন্টস কর্মী ।
সকাল বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে, কি এক মহা প্লাবনের ন্যায় আসছে তারা ।
এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে তাদের আসতে দেখা যায় ।
তাদের সম্পর্কে একেক জনের একেক মত ।
বাড়িওয়ালারা বলে- ঢাকা শহরটাকে নরকবাস বানিয়ে ছাড়ল গামের্ন্টস কর্মীরা ।
প্রশাসন বলে- দেশের অধিকাংশ খারাপ কাজ হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মী দ্বারা ।
জননেতারা বলেন- দেশের পোষাক শিল্পের মেরুদন্ড তারা ।
সাধারণ মানুষ বলে- ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় আর এবং জোটবদ্ধ বাহিণী হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মীরা ।
কিন্তু আমি বলি অন্য কথা । ওরা কত স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে নিজেদের গ্রাম-পরিবার ফেলে এই হিংস্র কসাইখানার শহর ঢাকায় এসেছে । দু’মুঠো খাবে, কিছু সঞ্চয় করবে পরিবার ও নিজের জন্য । হয়তো কঠিন কিন্তু অদূরে দন্ডায়মান বাস্তব ভবিষ্যতের জন্য ।
এত কিছুর মাঝেও তারা স্বপ্ন দেখে ।
সে স্বপ্ন একাকী নয় । আরেকজনকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন । তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অন্যরকম এক সমাজ । সে সমাজেও আছে প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি ।
কিন্তু তাদের এ সমাজ সভ্য সমাজের স্বীকৃতি হতে বঞ্চিত ও অবহেলিত ।
সকালে যখন গামের্ন্টস শুরু হয় এবং যখন রাতে ছুটি হয়, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু কমর্হীন বাউন্ডুলে ছেলে আর রিক্সাওয়ালারা ।
মেয়েদের দেখলে তারা শিস্ দেয় ।
রিক্সাওয়ালারা মুচকি মুচকি হাসে ।
অনেক সময় তাদের রিক্সার নিয়মিত যাত্রী হয় গামের্ন্টস কর্মীরা ।
রিক্সাওয়ালা তার কল্পিত মাসির্ডিজ গাড়ি নামের রিক্সায় রাজকন্যা নামের গামের্ন্টস কর্মীকে নিয়ে ছুটে চলে ।
যাই হোক, বাসস্ট্যান্ডে পৌছে দেখি সিটিং বাসে টিকিটের স্বল্পতা চলছে, আর লোকাল বাসে চলছে বাঁদড় নাচের প্রতিযোগিতা । কে কত সুন্দরভাবে বাঁদড় নাচ নাচবে, তার উপর ভিত্তি করে বাসে অবস্থান দৃঢ় হবে ।
অগত্যা আমিও বাঁদড় নাচের প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম ।
সকালের মিষ্টি রোদ আর মিষ্টি লাগছে না । বাস ছাড়তেই হঠাৎ ১ নাম্বারের এক মহিলা পাগলী চিৎকার শুরু করল- ওই ড্রাইভার, প্রধানমন্ত্রীরে ফালাইয়া কই যাস ? জলদি আমারে নিয়া যা ।
বলে কাপড়-চোপড় খুলে দিগম্বর হয়ে মহিলা পাগলী বাসের পিছনে দৌড়ানো শুরু করল । ততক্ষণে বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে ।
আহহা বেচারী, আমি আফসোস করি । কোন এক সময় সে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিল । তা না হলে এভাবে কোন মহিলার ব্রেন আউট হওয়ার প্রশ্নই আসেনা ।
কিন্তু তার মার্কা কি ছিল ? পাটগাছ, না জাহাজ মার্কা ?
সন্দেহে পড়ে যাই আমি ।
শ্যামলী
‘ওই হল শ্যামলী, হল শ্যামলী নামেন ।’ চিৎকার করে যাত্রীদের আহ্ববান করে হেল্পার ।
আমি জিগ্যেস করলাম- আচ্ছা ভাই, হল কই ?
হেল্পার আমাকে সামনে দেখিয়ে বলল- ওই যে ।
-কই হলতো নাই ।
-কি জানি, বলে মাথা চুলকাতে লাগল হেল্পার ।
আমি একজনের সিটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । লোকটা শ্যামলীতে নেমে গেল । আমি জ়ায়গা পেয়ে বসে গেলাম । সামনে অসংখ্য যানবাহন । সব শ্যামলীর সিগন্যালে আটকেছে । আমি সিটে বসে উশখুশ করতে লাগলাম । প্রচন্ড রোদের তাপে ঘর্ম স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সকলের গাত্রদাহ থেকে । তারওপর আবার বাসের ছাঁদ লোহার তৈরি । তাই গরম যেন শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকছে । এছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা দু-চারজন লোকের ঘাম বেয়ে বেয়ে চট করে আমার হাতে বা রানে পড়ছে ।
খুবই অস্তত্বিকর অবস্থা । আমার রুমাল মনে হয় আর ঘাম শুষতে পারছে না । ইতিমধ্যেই ভিজে ঢোল হয়ে গেছে রুমাল ।
এর মধ্যে ভিড় ঠেলে একজন ঠোঙা হাতে ঢুকল ।
-ভাইসব, আসসালামু আলাইকুম । বেশী কথা বলে বাচাল আর ক্যাম্পাসার । আমি কোনটাই না । তাই আপনাদের অনুরোধ করে বলছি যে একবার এই দাঁতের ঔষুধটা ব্যবহার করে দেখুন । দাঁতের পোকা থেকে ময়লাসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিবে । দাম লিখা আছে বিশ টাকা, কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছা সৌজন্যে এর দাম নিচ্ছি মাত্র দশ টাকা, দশ টাকা, দশ টাকা ।
বাংলাদেশের বড় বড় ডেন্টিস্টরা পাঁচশ টাকা, এক হাজার টাকা ভিজিট নিয়েও এই ঔষুধটা দিয়ে থাকেন । তাই আর দেরী না করে একবার এই ঔষুধটা ব্যবহার করুন এবং আপনার অমুল্য দাঁত বাঁচান । কে দিবেন দশ টাকা আমাকে ?
বলে সকলের দিকে তাকাল ঔষধ বিক্রেতা ।
দুই-চারজন কিনলও । এরমধ্যে সবুজ বাতি জ্বলে উঠল । বাস দ্রুত গতিতে এগোন শুরু করল ।
হেল্পার আমাকে জিগ্যেস করল- কই যাইবেন ভাই ?
-গুলিস্তান ।
-১২ টাকা দেন ।
-১২ টাকা দিব কেন ? আমি ছাত্র না ? রাগ করেই বলি আমি ।
-আইচ্ছা ৮ টাকা দেন ।
আমি আট টাকা দিলাম । বাস ততক্ষণে শ্যামলী ছেড়ে যাচ্ছে ।
সংসদ ভবন
সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছে বাস । বাম পাশে সংসদ ভবন । হঠাৎ মৃদু কাশি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল বাসের ইঞ্জিন । বার কয়েক স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল ড্রাইভার । এতেও যখন কাজ হল না, তখন হেল্পার দুজন আর অতি উৎসাহি চারজন যাত্রী বাস ধাক্কা দেয়া শুরু করল ।
কতক্ষন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল ড্রাইভার । যাত্রীদের প্রাপ্য টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বাসের ইঞ্জিন ঠিক করা শুরু করল ।
আমি সংসদ ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম । সংসদ ভবনের বিশাল এরিয়ার ফুটপাথে সারি সারি চটপটি আর চা-কফি সিগারেটের দোকান । আমি চটপটির চলমান টঙের দোকানের নাম পড়া শুরু করলাম ।
রংপুর চটপটি হাউজ, বরিশাল স্পেশাল চটপটি, পাবনা চটপটি বেকারী, চাঁদপুর নাইট-ফাইট উড়া-ধূড়া চটপটি ।
নাম পড়ছিলাম আর এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যেন যাচ্ছিলাম । তাদের নামের বাহারের প্রশংশা করতে হয় ।
এই পেশার মাধ্যমে এক শ্রেণীর নিম্নবিত্ত লোক তাদের সংসার চালাচ্ছে ।
না, তাদের কাস্টমার কোন মন্ত্রী-এমপি নয় । তাদের কাস্টমার হল সংসদে ঘুরতে আসা আমার মত সাধারণ মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভবঘুরে ।
আমি সংসদের গেইটের দিকে এগোতে লাগলাম । আকাশের কোথাও এক ফোটা মেঘের চিহ্ন নেই । দিগন্তের উধ্বর্মুখ হতে যেন নরকের আগুন প্রবাহিত করছে সূর্য্যমামা । রোদের তীব্রতায় পিচঢালা পথও মনে হয় গলে যাচ্ছে ।
এরি মাঝে কুলি আর শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করছে শুধু দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য ।
আমি সংসদ ভবনের সীমানায় প্রবেশ করতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করল- কোথায় যাবেন?
-কোথাও না, এমনিই ঘুরাঘুরি করছি ।
-আজকে ঘোরা যাবে না । সংসদের অধিবেশন শুরু হবে একটু পর ।
-ও। (আমি বোঝার চেষ্টা করি। )
হঠাৎ একটা কথা মনে হতে দাড়োয়ানকে আমি প্রশ্ন করি- আচ্ছা চাচা, আপনি কোন দল করেন? পাটগাছ মার্কা, না জাহাজ মার্কা?
-আমি কোন মার্কাই না । শালা-শালীরা বদমাইশ । (দাড়োয়ানের মুখে ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে )
-কেন কেন? আমি প্রশ্ন করি ।
-আরে যখন যেই দল ক্ষমতায় আইব, হেই দল সংসদের অধিবেশনে এমন সব ওয়াদা করব যেসব ওয়াদা হেগো বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির মধ্যে কেউ করে নাই ।
-ওইটা কোন সমস্যা না চাচা । মিথ্যা ওয়াদা ছাড়া রাজনীতি হয় না । এই যেমন এই কাজটা আপনি পারেন না দেখেই তো আপনি সংসদের দাড়োয়ান । যদি পারতেন, তাহলে সংসদে আপনার নামে আলাদা সিট থাকত ।
-হ ভাইস্তা, আপনি ঠিকই কইছেন ।
-আচ্ছা চাচা, আমি চলি ।
বলে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । একটু পর একটা গুলিস্তানের বাস পেয়ে গেলাম । তাও কানায় কানায় ঠাসা । ফার্মগেটে গিয়ে শুরু হল জ্যামের প্রতিযোগিতা ।
কোন রাস্তায় বেশী জ্যাম থাকবে তারই প্রতিযোগিতা । রোদের তাপ বাসের ধাতব শরীরে পড়ায় গরম যেন চরম হয়ে দ্বিগুন পরিমানে লাগছে ।
কাওরাণ বাজারের কাছে আসতেই আল্লাহ যেন মুখ তুলে চাইলেন ঢাকাবাসীকে । হঠাৎ আকাশ জুড়ে কাল-সাদা মেঘ । কিছুক্ষণ প্রচন্ড বাতাস হল । এরপরেই নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ।
পল্টন
এখন সকাল ১০টা বাজে । বাস পল্টনে থামতেই নেমে পড়লাম । এখানে একটু কাজ আছে । একটা পার্ট-টাইম জবের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছি ।
বড় একটা বিল্ডিং-এর নিচে দাঁড়ালাম । চারতলায় বড় করে ব্যানারে লেখা ডেসটিনি-২০০০ লিঃ ।
আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল । লিফট দিয়ে সাততলায় উঠলাম । ছয় নম্বর রুমের কাছে এসে ফোন দিতেই আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল একটা ছেলে ।
কাঁচের দরজা । ভিতরে এসি চলছে । পাঁচটা টেবিলে আট-দশজন মানুষ কাজে ব্যস্ত । একটা টেবিলের সামনের একটি মেয়ে আমাকে বসতে বলল ।
-আপনিই আরাফাত?
-জ্বি । (জবাব দিলাম আমি)
-আমাদের এখানে জব করার জন্য আপনাকে ছোট একটা কাজ করতে হবে । পারবেন আপনি?
-ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই পারব ।
-Good, আপনাকে সেলারি দেয়া হবে ৫,০০০ ৳ মাসে । এজন্য আপনাকে ২০ টাকা দিয়ে এই ফরমটা পূরণ করতে হবে আর ৫১৫ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ।
-তাহলেই কি আমার চাকরী শুরু? (বললাম আমি)
-না, এরপর আপনাকে এই ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে একজন বীমাকারীকে ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করাতে হবে । তাহলে আপনি চাকরীতে পামার্নেন্ট হবেন । এখন ফরমটা কি আমি পূরণ করে দিব?
-No Thanks, রাগ চেপে মুখে হাসি নিয়ে বললাম আমি ।
-আচ্ছা, রেজিস্ট্রেশন ফি আপনার জন্য কমিয়ে দিচ্ছি ।
-যদি পারেন পুরোটাই কমান, তা না হলে আমি আসি ।
-আচ্ছা ঠিক আছে, যান এটা মওকুফ করা হল । কিন্তু বীমাটা আপনাকে করাতে হবে ।
-বীমা করালে কি হবে?
-এখন ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করালে আপনি ২ বছর পর ৫০,০০০ টাকা পাবেন ।
-আচ্ছা, আপনাদের কোম্পানীর নাম কি? (আমি সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলাম)
-মুনলাইট ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিঃ ।
-শালীর ঘরের শালী । মনে মনে গাল দিয়ে উঠি আমি । মুখে বললাম- আপনাদের এই বীমা কোম্পানীর নাম জীবনের ফার্স্ট শুনলাম ।
-আসলে এটি নতুন এসেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তো । এর নাম পরে আরও শুনবেন ।
-আচ্ছ ঠিক আছে, পরে যখন আরও শুনব, তখন এসে না হয় চাকরীতে যোগদান করে যাব । (বলেই হনহন করে হেঁটে বের হয়ে এলাম)
--আমাদের চাকরীর পোস্টটা কিন্তু পরশু দিনের মধ্যেই ভরে যাচ্ছে ।
বের হতে হতে শুনলাম মেয়েটার এই শেষ বাক্য ।
গুলিস্তান
আবারও জ্যাম, আবারও সেই প্রচন্ড রোদ । রোদ দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে । গুলিস্তানের কাছাকাছি এসেছি। বাসের ভিতর একের পর এক ছোট-খাট বিক্রেতারা বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ঢুকছে ।
একজন এসে বলল- ওই ঠান্ডা পানি লন । মাত্র ১০ টাকা এক বোতল । লগে একটা চকলেট ফিরি (ফ্রি) ।
চকলেটের জন্য নয়, গলা ভেজানোর জন্য অনেকেই পানি কিনল । আমিও কিনলাম একটা ।
একটু পর এল রুমাল বিক্রেতা- ওই রুমাল লন, ঘাম মুছেন । জোড়া ১০ টাকা, একটা পাঁচ টাকা ।
এরপর এল আইসক্রীম- এই গরমে, ঠান্ডা খান আরামে ।
আমি এদের ব্যবসার টেকনিক দেখে অবাক হয়ে যাই । কি চমৎকারভাবে প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের চাহিদার পরিবতর্ন অনুযায়ী এরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে । আসলে দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতেই তাদের এত ধান্দা-ফিকির করতে হয় । জীবনের নিমর্মতা তাদেরকে করেছে দুরভিসন্ধী ও সুযোগ সন্ধানী ।
গুলিস্তানে এসে পড়েছি, কিন্তু এত জ্যাম । রাস্তা পার হব কি করে । যেদিকে তাকাই শুধু রিক্সা,বাস,প্রাইভেটকারের বাজার বসেছে ।
ট্রাফিক পুলিশ এক হাতে লাঠি আর এক হাতে সুই নিয়ে এগিয়ে এল । এসেই সমানে রিক্সাওয়ালাদের পিঠে গায়ের জোর দিয়ে বাড়ি মারতে লাগল আর সুই দিয়ে টায়ার ফুটা করে দিতে লাগল ।
যেন বিদ্রোহী জনতাকে দমন করছে দাঙা পুলিশ ।
ট্রাফিক পুলিশের ধারণা রিক্সাওয়ালাদের ভাগাতে পারলেই শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের যাতায়াতের একমাত্র বাহণ যে রিক্সা এ কথা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে চায় না
মাজারের অপর পাশ হতে ডাকছে টমটম ঘোড়ার গাড়োয়ান- ওই সদরঘাট আহেন ১০ টাকা, সদরঘাট আহেন ১০ টাকা ।
আমি টমটমে চড়ে বসলাম । মানুষ ভরে যেতেই ঘোড়া চলা শুরু করল । ইংলিশ রোডে আবার প্রচন্ড জ্যাম ।
আমি ঘামে ভিজে প্রায় গোসল করে ফেলেছি ।
হঠাৎ দেখি এক লোক রিক্সাওয়ালার কলার ধরে টানছে। হেঁচকা টান দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে সে রিক্সা হতে নামাল ।
‘ভাড়া বেশী চাইছস কেন? ’ বলেই সজোড়ে চটোপাঘাত করল রিক্সাওয়ালাকে ।
-ভাই ভুল হইছে ভাই, মাফ কইরা দেন । বলে রিক্সাওয়ালা পা ধরে ফেলল লোকটার ।
সামনে কতগুলো স্মার্ট মেয়ে গাড়িতে বসেছিল ।
বিধাতার কি অপুর্ব নিয়ম! রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেকের শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়, আবার অনেকে গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে এসির বাতাস খায় ।
এই হিংস্র নিষ্টুর শহরে কেউ কাউকে দয়া, ভিক্ষা কিংবা করুণাও করেনা ।
একটু সামনে গিয়ে দেখি আরেক ছেলে রিক্সাওয়ালাকে কলার ধরে নামিয়েই ধাম করে ঘুষি বসিয়ে দিল মুখে। ঘুষির চোটে রিক্সাওয়ালার নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসল।
এবার রিক্সাওয়ালা উঠে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে বেসামাল করে দিল। তারপর সেও কয়েকটা ঘুষি চালিয়ে দিল ছেলেটার নাকে-মুখে।
গরীব আর অসহায় বলে ওরা কি সব সময় অত্যাচার আর মারধোর ভোগ করবে?
না, ওরাও এক সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠে যখন অত্যাচারের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে যায়। এসময় সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠেল। আমাদের টমটম এগিয়ে চলল সদরঘাটের পথে।
বাংলাবাজার
ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১২ টা বাজে। সদরঘাট আর বাংলাবাজার-এর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছি।
সোজা হাটা শুরু করলাম বাংলাবাজারের গলির ভিতর। পাঁচ মিনিট পর পৌছে গেলাম গন্তব্যস্থলে।
সত্যকথা প্রকাশনী
বড় করে লেখা রয়েছে উপরে। আমি ভিতরে ঢুকে প্রকাশক সাহেবকে সালাম দিলাম। উনার নাম রণি আহমেদ।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?
-এইতো ভালই, আমার উপন্যাস বের হবে কবে?
-ভাই আপনিতো বাংলাবাজার থাকেন না, দিনের মধ্যে চৌদ্দ-পনের বার লোডশেডিং হয়। এ কারণে আমাদের প্রকাশণীর কাজ খুব স্লো ভাবে চলছে।
-এখন ভাই আপনিতো জানেনই যে আমি এই উপন্যাস প্রথম আলো পত্রিকায় জমা দিব। সময়তো বেশী নেই। তাড়াতাড়ি করেন না একটু। (আমি প্রকাশক সাহেবকে সমস্যা বোঝাই)
-আইচ্ছা যান, তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করব।
-তো আসি ভাই। বলে বিদায় নিয়ে আসলাম। প্রকাশকের সাহেবের পাশের রুমে কয়েকজন ছেলে বসে রয়েছে। এদের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন লেখক মানুষ।
খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি আর বড় বড় বাবরি চুল। অনেকে কানে রিঙও পড়েছে। কাঁধেও ব্যাগ ঝুলানো রয়েছে।
একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম। সাধারণ পোষাক, স্লিম ফিগার, ক্লিন সেভড আর সাদা চশমা পড়া এক ইনোসেন্ট বয়।
অবশ্য চশমা খুললে নাকি আমাকে শয়তান শয়তান বলে মনে হয়। (আমার বন্ধুদের কথা)
একজন লেখককে প্রশ্ন করলাম।
-ভাই আপনার কি কোন উপন্যাস বের হচ্ছে?
-হ্যাঁ, উপন্যাসের নাম ‘তোমার মরণ হলে আমারও মরণ হবে’ । এই যে দেখুন বই। আমি বইটি হাতে নিলাম, প্রচ্ছদে শাবনূর আর শাকিব খানের ছবি। কিন্তু ছবির নায়ক-নায়িকার নাম লিখা আছে রিয়াজ আর পূণির্মা। আমি বেশ অবাক হলাম, কিন্তু কিছু বললাম না।
-আমার নাম শ্যামল। এই নিন, বইটা আপনাকে উপহার দিলাম।
-অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার একটা বই বের হচ্ছে, নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ । বইটি অবশ্যই আপনি নিয়ে যাবেন।
-জ্বি অবশ্যই।
আরেকজন লেখকের সাথে কথা বললাম।
-ভাই, এটিকি আপনার বই?
-জ্বি, এই যে দেখুন।
আমি দেখলাম বইয়ের নাম ‘রঙিলা মাইয়া’ ।
-আপনার আর কোন বই বের হয়েছে? (প্রশ্ন করলাম আমি)
-অনেকগুলো, এই যেমন- ‘সুন্দরী মেয়ে, রসিয়া বন্ধু, পীরিতের আগুন, গরীবের ভালবাসা, রক্ত দিয়ে প্রেমের শুরু ------------
-থাক আর বলতে হবে না, আপনিতো তাহলে একজন খ্যাতিমান লেখক।
আমার কথায় যেন সে লজ্জা পেল। বলল
-না, তা এখনো হতে পারিনি, তবে হয়ে যাব শীঘ্রি।
আর একজন লেখকের দিকে এগোলাম। পরনে জিন্সের প্যান্ট, পেস্ট কালার গেঞ্জি। মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, হাতে ব্রেসলেট আর কানে ব্লুটুথ।
বড় লোকের ছেলে, তাকালেই বোঝা যায়।
-ভাই কি লেখক নাকি?
প্রশ্ন করতেই সে যা শুরু করল আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পাগল নাকিরে বাবা? আমায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে চেয়ারে বসাল সে। তারপর তার কাঁধের ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করল।
তাতে তার লিখা উপন্যাসের নামের তালিকা। কমপক্ষে এক হাজার হবে।
নামের বৈচিত্রও ভিন্নরকম। যেমন-
১. পাগলা মামু,
২. ন্যাঙটা বাবা,
৩. ট্যানাড়ির ভূত,
৪. ছাগলনাইয়া,
৫. ভেড়ামারার মরা ভেড়া,
৬. সেক্রোসাইনিস্টের দেশে ................. ইত্যাদি
নামের তালিকা আমার হাতে দিয়ে ছেলেটা বলল,
-দেখুন, এগুলো সব আমার লিখা উপন্যাস। এগুলোর প্রায় সবগুলো বুকার, পোকার, নোভেল প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন প্রাইজ পাচ্ছিনা কেন বলতে পারেন?
আমি ছেলেটার জন্য আফসোস বোধ করলাম। আসলে হওয়ারই কথা। লাখ-লাখ টাকা খরচ করে এত উপন্যাস বের করছে, অথচ কোন স্বীকৃতি পাচ্ছে না। বললাম
-আপনি বরং এক কাজ করুন, এসব উল্টো-পাল্টা কাহিণী না লিখে গ্রাম বাংলার মানুষ ও সমাজকে নিয়ে কিংবা জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা নিয়ে লিখুন, যেখানে জীবনের ঘটনা সহজে ফুটে উঠবে।
-কি বললেন আপনি? আমি উল্টা-পাল্টা কাহিণী লিখি?
ছেলেটার চোখ-মুখ গরম হয়ে ভয়ানক আকৃতি ধারণ করল। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম
-না, মানে আপনার এই বিখ্যাত অত্যাধুনিক সাহিত্যগাঁথা বেশী বড় তো! এক কাজ করুন, আরও ছোট করে বের করুন, তাহলে লোকে পড়বে। আর আপনিও পুরস্কার জিতবেন।
ছেলেটা মনে হয় এবার কিছুটা শান্ত হল। আমি তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে এলাম। এরকম মাথা গরম লোকের সামনে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।
ধানমন্ডি
দুপুর ২টা বাজছে। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ১০ মিনিট হেঁটে নিউমাকের্ট পৌছলাম। ওভার ব্রিজের পাশের মাকের্টে বেশ কয়েকটা হোটেল। আমি রাস্তার পাশে ছোট একটা হোটেলে ঢুকলাম।
আমি যে হোটেলে বসেছি তার পাশেই একটা আবাসিক হোটেল। উপরে নাম লিখা- ‘হোটেল গ্যালাক্সি প্রাঃ লিঃ ’।
একটু পর পর দেখি একেকজন ঢুকে আর বের হয়। এত তাড়াতাড়ি তারা কি করে বুঝতে পারলাম না। আমি ভাত খেয়ে আবাসিক হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দাঁড়োয়ান বলল,
-কি ভাই, লাগব?
-কত কইরা?
-দেশী মদ ২৫০,ভদকা ৬০০, হুইস্কি ৮০০, আর শ্যাম্পেন ৩০০০ টাকা।
-পুলিশে দেখবো নাতো ভাই?
-আরে কি কন, ধানমন্ডি থানার পুলিশ আমগো পকেটে।
আমি থ হয়ে গেলাম। এই কাজেও প্রশাসনের সহযোগিতা?
আমি চলে যেতে নিচ্ছিলাম, দাঁড়োয়ান প্রশ্ন করল,
-কি ভাই নিবেন না?
-না ভাই। বলে দ্রূত সরে পড়লাম।
ধানমন্ডিতে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে। হঠাৎ তারা এক মোটর সাইকেল আরোহীকে থামাল। আরোহী অল্প বয়সী এক ছেলে।
পুলিশ অফিসার বলল- এই ছেলে, তোমার হুন্ডার কাগজ পত্র আছে?
-জ্বি আছে।
-কই দেখি বের কর।
ছেলেটা লাইসেন্সের ফটোকপি বের করল।
পুলিশ অফিসার বলল- তোমার লাইসেন্সে সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। এই কারণে তুমি ফটোকপি সাথে রাখছ। তোমার বয়সও এখন কম। কাজেই তোমার হুন্ডা চালানো বেআইনী হয়েছে। এখন তুমি কি বল?
-কি বলছেন আঙ্কেল! আমার বয়স ১৯, তাছাড়া আমার লাইসেন্সও ঠিক আছে।
-না না, তোমাকে এখন হুন্ডার সাথে থানায় যেতে হবে। (বলে মুচকী হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল অফিসার)
ছেলেটা সবই বুঝতে পারল। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করল। পুলিশ অফিসার টাকা নিয়েই সাথে সাথে পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বলল,
-আচ্ছা ঠিক আছে, যাও সমস্যা নেই। কিন্তু এরপর থেকে সাবধানে হুন্ডা চালাবে।
ছেলেটা মাথা কাত করে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে মিশে গেল ঢাকা শহরে।
আমি এতক্ষণ অবাক হয়ে দৃশ্যগুলো দেখছিলাম। বাহ! বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ করা জনগণের বন্ধুরা(পুলিশ) যে জনগণের এত কাছে পৌছে যাবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। পৌনে তিনটা বাজে। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
একটা সিএনজি ডাক দিলাম
-এই সিএনজি, কাওরাণবাজার যাবেন?
-যামু।
-চলেন।
-ভাড়া কইলাম ১০০ টাকা।
-কেন কেন? মিটারে যাবেন না?
-না।
-আচ্ছা থাক যাব না। (বললাম আমি)
-মিটারেরতে বিশ টাকা বেশী দিবেন?
-না, দশ টাকা বেশী দিব।
-আইচ্ছা লন।
আমি উঠে বসলাম সিএনজিতে।
জ্যামে আটকা পড়তেই একটি ছোট মেয়ে এগিয়ে এল। হাতে কয়েকটা ফুল। বলল- ভাইজান, একটা ফুল নেন না।
-কত করে ফুল?
-দুইডা দশ টাকা।
-আচ্ছা, দুইটা দাও।
আমি দশ টাকা বের করে দিলাম। ফকিরকে কিছু দান করার চেয়ে এদেরকে দেয়াই ভাল। কারণ ফকিররা বিনা শ্রমে হাত পেতে নিতে চায়। আর ওরা পরিশ্রম করে তার বিনিময়ে দু মুঠো খেতে চায়। ওদের অবশ্য বাড়ি-ঘর নেই। রাতের ঢাকা শহরে বের হলে দেখা যায় ওদের বাসস্থান। রাস্তাই ওদের ঘর, ওদের বিশ্রামখানা, খেলার স্থান। ওদের কখনো সৌভাগ্য হয়নি কোন ছাউনির নিছে একটি রাত ঘুমিয়ে কাটাবার।
সরকার ও নেতা/নেত্রীদের সুদৃষ্টি হতে বঞ্চিত ওরা। তারপরও ওদের কোন আফসুস নেই, নেই কোন অভিযোগ।
কাওরাণবাজার
পম-পম...........পম
ঝক-ঝক, ঝক-ঝক, ঝক-ঝক।
হুইসেল দিয়ে তীব্র গতিতে কমলাপুর স্টেষন থেকে ছুটে আসা বিশাল আন্তঃনগর ট্রেন কাওরাণবাজার রেলগেট অতিক্রম করল। ট্রেন চলে যেতেই রেলগেট উঠিয়ে দিল লাইনম্যান। আবার চলাচল শুরু হল ট্রাক, গাড়ি, রিক্সা, সিএনজি ইত্যাদি।
বামপাশেই তেজগাঁও রেলস্টেষন। একটা লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পাশের লাইনে বিশাল এক মালগাড়ি।
আমি যাব ডানপাশে, একটা রেললাইন মোড় নিয়েছে চাল-ডালের গুদামের দিকে। ওই গুদামের ডান পাশেই আমার খালুর বাসা। এখন চারটা বাজে। সূ্যর্টা প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঘিঞ্জি আর দূষণযুক্ত ঢাকা শহরে। আমি লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
এই লাইনে ট্রেন আসে মাসে দুই এক বার। চাল-ডাল বা শষ্যাদি নিয়ে যায় অথবা দিয়ে যায় মালগাড়ি। দুই পাশে ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষের সারি সারি বস্তি ঘর।
ঘরগুলো বেড়া, নীল মোটা পলিথিন আর বাশের সাহায্যে বানানো হয়েছে। অধিকাংশ ঘরেই কোন চৌকি বা বিছানা নেই। তবে রেডিও কিংবা টেলিভিশন আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই আছে। শিশুগুলো উলঙ্গভাবে খেলা করছে লাইনের উপরে। অলস, ক্লান্ত আর অবসন্ন বৃদ্ধরা লাইনের উপর বসে উদাসভাবে চেয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ কিংবা বর্ষার প্রবল বষর্ণ এখন আর তাদের স্পর্শ করেনা। কারণ জীবন যুদ্ধে তারা পরাজিত সৈনিক।
বস্তিবাসীরা ঘরের ভিতরই রান্না করে। তাদের পায়খানার ব্যবস্থাত খুবই করুণ। বিভিন্ন ময়লা-আবজর্না তারা লাইনের উপরই ফেলে। অনেকে অভাবের তাড়নায় যে রেললাইনের দুই একটা স্লিপার বা নাট-বল্টু চুরি করেনা তা নয়। বরং এর জন্য তারা বিবেকের কাছে অপরাধী।
এছাড়া আর কিই বা করার আছে তাদের। ক্ষুধার জ্বালা যখন পেটে সৃষ্টি হয়, তখন মনতো আর মানে না।
নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। আমি এসব দৃশ্য দেখছিলাম আর লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। প্রচন্ড উৎকট দুগর্ন্ধ চারপাশে। কিন্তু এর মধ্যে বেঁচে থাকার অভ্যাস তাদের আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি খালুর বাসায় উপস্থিত হলাম।
খালু আমাকে দেখে বেশ খুশী হলেন। আমি সালাম দিয়ে খালুর কুশলাদি জিগ্যেস করলাম।
খালু বললেন- আইজকা এফডিসির শুটিং হইছিল আমগো গুদামের ভিতরে।
-তাই নাকি! আপনিও কি অভিনয় করেছেন?
-হ, (খালু মুচকি হাসি দেন) আমার রোল আছিল নায়ক শাকিব খানরে একটা চাউলের বস্তা উঢাইয়া দিমু।
-ভাল,(আমি মন্তব্য করি)। আচ্ছা খালু, এফডিসি কোন জায়গায়?
-এহান থিকা রেললাইন দিয়া সোজা হাইটা গেলে প্রথমে যে রোড পড়ব, হেই রোডের বাম সাইডে গেলেই এফডিসি পাবি।
কিছুক্ষণ পর খালু আমাকে ঘরে বসিয়ে বাইরে গেলেন। আমি একা একা উশখুশ করছিলাম, হঠাৎ দরজার বাইরে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল।
-কাকা কোথায়?
-কাকা, মানে আমার ইউনুস খালু?
-জ্বি।
-উনি একটু বাইরে আছেন। কোন সমস্যা? (আমি জানতে চাইলাম)
-না না, এমনিই। আচ্ছা, আপনি উনার কি হন?
-আমি উনার কি হই তাতো আমি বলতে পারব না, তবে উনি আমার খালু হন।
-ও, তার মানে আপনি উনার শ্যালিকার ছেলে।
-জ্বি, আপনি বেশ বুদ্ধিমতি তো! ঠিক ধরে ফেলেছেন।
আমার কথা শুনে মেয়েটা খিক খিক করে হেসে উঠল।
-আপনার হাসিটা বেশ চমৎকার, তবে আরো চমৎকার আমার চাচাত বোন মৌসুমির হাসি।
-তাই নাকি? (সহাস্যে বলল মেয়েটা)
-জ্বি
-আপনি কিন্তু আমাকে সূক্ষভাবে ইনসাল্ট(অপমান) করার চেষ্টা করছেন।
-স্যরি,যাই হোক আপনার নামটা শুনতে পারি?
-জ্বি অবশ্যই, আমি দিনা। ক্লাস টেইন-এ পড়ছি ত্বেজগাঁও হাই স্কুলে। আপনি?
-আমি মোঃআরাফাত হোসেন, এবার এসএসসি পাস করলাম। বতর্মানে মিরপুর কলেজে ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছি। পাশাপাশি আমি একজন শখের লেখক এবং সাহিত্যিক।
-ওরে বাবা, আপনার পদতো অনেক বিশাল! (মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল)
আমি মৃদু হাসলাম। কোন কিছুই আমার জীবনে সুখ দিতে পারবে না, যদি মৌসুমি আমার জীবনে না আসে।
মুখে বললাম- হয়তো বা। আচ্ছা, আপনি খালুর কি হন?
-আমি এ বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে। বাসা স্কুলের পাশেরই একটা বিল্ডিং এর তিনতলায়। মাসে মাসে আমিই ভাড়া উঠাতে আসি।
-আপনার বাবা?
মেয়েটা আমার কথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক শক খেল।
-বাবাতো নেই। মারা গেছেন, মানে মারা হয়েছে। তেজগাঁও-এর সন্ত্রাসীরা আমার বাবাকে গুলি করে মেরেছে। আমার বাবার অপরাধ ছিল তিনি একটা খুনের চাক্ষুশ স্বাক্ষী ছিলেন। যাক বাদ দিন এসব কথা। আপনার বাসা কোথায়?
-আমার বাসা মিরপুর-১ নাম্বারে।
এর মধ্যে খালু এসে উপস্থিত হলেন। হাতে পোটলার ভিতর পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা।
-আরে দিনা, কখন আইছ তুমি?
-এইত কাকা, কিছুক্ষণ আগে।
-বস বস, (বলে খালু চেয়ার এগিয়ে দিলেন)।
দিনা চেয়ারে না বসে আমার সাথে বিছানার এক পাশে বসে পড়ল।
খালু একটা বাটিতে পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা ঢেলে দিলেন।
খালু পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দিনাকে বললেন- ও হইল আমার শালির পোলা।
খালুর কথা শুনে আমি আর দিনা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
-খাও, খাও না কেন তোমরা? (বলে খালু বাটি এগিয়ে দিলেন মাঝখানে)
-খালু আমি একটু এফডিসিতে যাব।
-যাইস, মাগরিবের আজান দিয়া লউক। টাকা আছেনি তোরতে? একশ টাকা লাগব কইলাম ঢুকতে।
-কেন কেন? টাকা লাগবে কেন এফডিসিতে ঢুকতে? ওটা কি চিড়িয়াখানা না জাদুঘর যে টাকা লাগবে?
-দাড়োয়ান টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না। (বোঝালেন আমাকে খালু)
-আশ্চর্য! (অবাক হই আমি) জনগণের টাকায় যারা বেঁচে আছে তারাই কিনা জনগণকে টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না!
-আমাগো সোহাগে গেছিল না। লগে আরও দুইজন আছিল। তিনজনেরতে দাড়োয়ান দুইশ টাকা রাখছে।
-আচ্ছা, টাকা লাগলে দেখা যাবে।
-এইল একশ টাকা (খালু আমাকে টাকা দিতে চান) ।
-আরে করেন কি খালু? আমার কাছে টাকা আছে তো।
-এফডিসির কথা এত জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি কি এখন এফডিসিতে যাবা? (দিনা প্রশ্ন করল)
আমি লক্ষ্য করলাম ও আমাকে আপনি থেকে তুমি করে বলা শুরু করেছে।
-হ্যাঁ, এখনই যেতে চাই।
-চল, আমি তোমাকে এগিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দেই। খালুর নিকট হতে বিদায় নিয়ে এসে পড়লাম। এফডিসি দেখে ফার্মগেট ঘুরে তারপর মিরপুর যাব।
দুই মিনিট পর আমরা রেললাইনে এসে উঠলাম। আমি আর দিনা পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
শেষ বিকেলের মৃদু রোদের আভা দিনার গায়ে পড়ছে। তাতে ওর ফর্সা ভরাট মুখটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। নীল রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়া, কাজলটানা মায়াবী দুই চোখ, আকর্ষণীয় হ্রদয়কাড়া হাসি সাধারণের মাঝেই অত্যন্ত অসাধারণ এবং চমৎকার একটি মেয়ে।
যেকোন ছেলেকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দিনা।
হঠাৎ দিনা বলল- আরাফাত, তোমার হাতটা একটু ধরব?
-ধর।
কিছুক্ষণ নিরিবিলি হাঁটা। আবার প্রশ্ন করল দিনা- আচ্ছা তুমি কি কাউকে ভালবাস?
-হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।
দিনা মৃদুভাবে শিউরে উঠল। বলল- কাকে?
-আমার আপন চাচাত বোন মৌসুমিকে।
-সেকি তোমাকে ভালবাসে?
-না।
-আশ্চর্য! তোমাকে ভালবাসে না?
-বললাম তো, না।
-কখনও কি ভালবাসেনি? আবার প্রশ্ন করে দিনা।
-হ্যাঁ বেসেছে, মানে বাসেনি। ইয়ে ভালবেসেছে নাকি ভালবাসে নি তা এখনও বলতে পারব না। তবে ওকে যখন আমি প্রেম নিবেদন করেছিলাম, তখন ও গ্রহণ করেনি। পরে করল, তাও একটা শর্ত। এস.এস.সি পাস করতে হবে। আমি আস্তে আস্তে ওর প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে গেলাম। মৌসুমিও দুর্বল হয়ে পড়ল আমার প্রতি। ভালবাসার স্বপ্ন, আশা আর কল্পনার জাল বুনতে শিখাল ও আমাকে।
তারপর, তারপর হঠাৎ একদিন আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে বলল- “আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি যা কিছু করেছি তোমার সাথে, তা ছিল আমার অভিনয়। এমন কি তোমাকে জড়িয়ে ধরা, তোমার সাথে কিস (চুম্বন) করা এগুলোও ছিল আমার অভিনয়ের অংশ। তোমার সাথে অভিনয় না করলে তুমি এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে না। তুমি আমাকে ভুলে যাও, কারণ আমি ফয়সাল নামের আরেকজনকে ভালোবাসি।”
আমি খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু মৌসুমি আমার কান্নার মুল্য দেয়নি। আমার কষ্ট একটাই। কেন ও আমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাল? ভালোবাসার নামে কেউ কারো সাথে অভিনয় করে? তাও আবার আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে।
-পাষন্ড ডাইনী, মন্তব্য করল দিনা।
-খবরদার দিনা, আমি গর্জে উঠলাম। মৌসুমিকে নিয়ে কোন বাজে কথা আমার সামনে বলবে না।
-ও আচ্ছা, স্যরি, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও আমাকে।
আমি দিনার চোখের কোণে পানি দেখতে পেলাম। আমার হঠাৎ ভিষণ মন খারাপ হল। বাপ মরা মেয়েটাকে আমি ধমক দিয়েছি মৌসুমির কারণে।
ডানহাত দিয়ে দিনার চোখের কোণ হতে পানি মুছে দিলাম।
-স্যরি, তুমি কাঁদছ কেন? আসলে আমি একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম।
দিনা আমার বুকে মাথা রেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল।
আমি ওকে সান্তনা দিতে লাগলাম। দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর আমাদের পাশ কাটালো একটি আন্তঃনগর ট্রেন।
-বিশ্বাস কর, তোমার মত ভাল ছেলে আমি আগে কখনও দেখিনি। কেন জানি তোমাকে আমার ভাল লেগে গেছে।
-তুমি ভুল ভাবছ দিনা। আমি তেমন ভাল ছেলে নই। আমার মধ্যেও শয়তান বাস করে। তাছাড়া আমি মৌসুমিকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারব না। এটা আমি ওর কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছি।
-কিন্তু ওই মেয়েটাতো তোমাকে বুঝতে পারছে না।
-তুমি কিচ্ছু ভেবনা। দেখবে আমার মৌসুমি একদিন ঠিকই আমার কাছে এসে হাজির হবে।
-আরাফাত?
-কি দিনা?
-সন্ধ্যা হয়েছে, আমাকে চলে যেতে হবে। তোমার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দাও।
-লেখ 01917-592041 , মিসকল দিলেই হবে।
-সে আমি দেখে নিব। এবার দয়া করে আমাকে বিদায় দাও।
-ঠিক আছে এসো।
দিনা চলে যাওয়ার সময় বলল- আবার এসো।
-আচ্ছা আসব।
• এফডিসির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। বিশাল সাইনবোর্ডে লাল-নীল আলোয় লিখা আছে ;
‘BFDC’
এফডিসির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সকলে অধীর আগ্রহের সাথে গেটের ফাঁক দিয়ে এফডিসির ভিতরে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয় নায়ক-নায়িকা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যদি একটু সামনা সামনি চক্ষুদর্শণ করা যায়।
অধিকাংশই গার্মেন্টস কর্মী, কুলি-মজুর আর ছোট-খাট খুচরা ব্যবসায়ী।
সাধারণ জনগণের সময় কোথায় যে তাদের কাজ-কর্ম ফেলে বাংলাদেশের পৃথিবী কাঁপানো সুপারস্টারদের দেখতে আসে!!
তাইতো নায়ক-নায়িকা, পরিচালকরা আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবার সাথে মুড দেখাতে পারেন না। দেখালেও দেখান গার্মেন্টস শ্রমিক কিংবা কুলিদের সাথে।
এক জায়গায় দেখতে পেলাম আট-দশটা ছেলে এফডিসির দাড়োয়ানের সাথে দর কষাকষি করছে।
আমি তাদের সামনে দাঁড়ালাম।
দাড়োয়ান বলছে- দশজন ঢুকবেন, একদাম এক হাজার টাকা দিবেন।
ছেলে- ভাই পাঁচশ রাখেন না।
-না না কম হবে না। ঢুকলে ঢুকেন, নেয়লে যান গা।
ছেলেগুলো বিমর্ষ মুখে আরো তিনশ টাকা বের করে দাড়োয়ানকে আটশ টাকা দিল। ভিতরে ঢুকে ছেলেগুলো এমনভাবে তাকাতে লাগল যেন জান্নাত দর্শণে এসে পড়েছে।
আমি অবাক হলাম এ দৃশ্য দেখে। নায়ক-নায়িকাদের প্রতি তাদের এত ভালবাসা!
নাকি গোটা উঠলে পাছা যেমন চুলকায়, এও তাদের এমন এক চুলকানি।
এফডিসি ঘুরব, তাও কিনা দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে ঢুকতে হবে। আমি কিছুক্ষণ পায়চারি শুরু করলাম। দোকান থেকে একটা বেনসন সিগারেট কিনে মুখে ধরালাম। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে মুড নিয়ে সোজা এফডিসির ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে ঢুকে আমার বেশ আত্নতৃপ্তি হল।
প্রথমে একটা নিচতলা ছোট বিল্ডিং, তারপর লাল একটা বহুতল বিল্ডিং। তার সামনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের বিভিন্ন নির্দেশনা ঝুলানো রয়েছে।
পুরো চত্বর ঘুরেও আমি মিডিয়ার কোন পরিচিত লোক দেখতে পেলাম না। সম্ভবত সন্ধ্যার অনেক পরে এসেছি বলে হয়তো।
বিকালে আসলে নিশ্চয়ই দু-চারজন নায়ক-নায়িকা দেখতে পেতাম।
বাংলার নায়ক-নায়িকাদের আমার মনে হয় যেন চিড়িয়াখানার জন্তু। লোকে কত শখ করে দাড়োয়ানকে টাকার টিকেট দিয়ে তাদের দেখতে আসে।
দশ মিনিট ঘুরে ফিরে আমি এফডিসি হতে বের হলাম। সাথে সাথেই দশ-বারজন ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এফডিসির মাস্তান নাকিরে বাবা?
মোবাইল আর টাকায় হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেই একটা ছেলে আমাকে বলল- ভাইজান, একটু এদিকে আহেন।
-কেন ভাই, কি হয়েছে?
-আহেন না ভাই, বলে আমাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই এফডিসির বামপার্শস্থ একটা দোকানে বসাল।
ছেলেটা বলল- কি খাইবেন ভাই, গরম না ঠান্ডা?
-ঠান্ডা মানে, আমাকে কেন খাওয়াবেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
-ওই হাফ লিটার মোজ়ো দেও তো। দোকানীকে বলল ছেলেটা।
আমার এক হাতে মোজ়ো আর এক হাতে চা।
-ভাই কি সিগারেট খান?
-বেনসন খাই, মানে, কেন ভাই?
সে জবাব দেয় না। এবার হাতে চায়ের সাথে বেনসন সিগারেটও এসেছে।
আমি অবাক হই। এরা খাওয়াচ্ছে কেন আমাকে!
-ভাই, আমার নাম আইউব। নারায়ণগঞ্জ গার্মেন্টসে কাজ করি। ভাইয়ে কি করেন?
-আমার নাম মোঃ আরাফাত হোসেন, পড়াশোনা করছি। বাসা মিরপুর এক নাম্বারে।
-ভাই ঝালমুড়ি খাইবেন?
-ঝালমুড়ি? আমি মুখ দিয়ে প্রশ্ন করতেই আইউব অর্ডার দিয়ে দিল। হ্যাঁ কিংবা না বলার প্রয়োজন পড়ল না।
-দশ টাকার মুড়ি দেওতো ভাইরে। সুন্দর কইরা বানাইয়া দিও।
আইউব অর্ডার দিয়ে ফেলে।
আমি চুপচাপ খাবার খেতে থাকি। এদের আচরণে মনে হচ্ছে না যে এরা চোর-বাটপার। বরং মনে হচ্ছে এরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ।
কিছুক্ষণ পর আইউব আমাকে প্রশ্নগুলো করল- ভাই আপনে ভিতরে ঢুকছেন কেমনে? আপনে কি সিনেমার কোন লোক? নাকি আপনের পরিচিত কেউ আছে? আমরা কি কি ভিতরে ঢুকতে পারমু না?
ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন।
আমি চোখ হতে চশমাটা নামিয়ে বললাম- আস্তে ভাই,আস্তে। আমি ভিতরে ঢুকেছি পায়ে হেঁটে, আমি সিনেমার কোন লোক না, আমার পরিচিত কেউ এই ঢালিউডে মানে সিনেমায় নেই এবং আপনারাও ভিতরে ঢুকতে পারবেন।
-কই দাড়োয়ানতো ভিতরে ঢুকতে দেয় না।
-দাড়োয়ানের কাছ থেকে আপনারা অনুমতি নিতে যান কেন? আমিতো কারো অনুমতি নেই নি। সামান্য একজন দাড়োয়ান কিভাবে আপনাদের থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়?
আমার এ কথার জবাব কেউ দিতে পারল না।
আরো ঘন্টাখানেক আইউব আর তার বন্ধু-বান্ধবদেরকে উপদেশ ঝাড়লাম।
বিদায় নিয়ে হাযির হলাম ফার্মগেটে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত আটটা চল্লিশ বাজে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ফার্মগেটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে। অদূরেই বিখ্যাত আনন্দ সিনেমা হল। উপরে বিশাল এক টিভি সেট করা। তাতে একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে।
এই মূহুর্তে পুরো ফার্মগেটে বাস,ট্রাক,রিক্সা,গাড়ি,মোটর সাইকেল প্রভৃতির ছড়াছড়ি। সারাদিনের কাজ-কর্মের পর মানুষ নীড়ে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আনন্দ সিনেমা হলের সামনে যেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। এই মুহূর্তে ছবির টিকেট বিক্রি হচ্ছে হলের কাউন্টারে। ছবির নাম- “ স্বামী কেন আসামী ”।
কয়েকশ মানুষ টিকেট কেনার জন্য কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
অধিকাংশই শ্রমিক কিংবা রিক্সাওয়ালা। কারণ আজকাল এরা ছাড়া বাংলা ছবি কেউ খুব একটা দেখে না।
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে গেল। অনেকেই এতে ক্ষেপে গিয়ে হাঙামা শুরু করল। হলের দাড়োয়ান যেইমাত্র হলের দড়জা খুলে দিল, অমনি সবাই একসাথে হট্টগোল আর চেঁচামেচি করে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকতে লাগল।
আমি বিস্ময়ের সাথে এসব দৃশ্য দেখছিলাম। অনেকে হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে যেয়ে মোটামুটি ব্যথা পেল। কিন্তু সেদিকে তাদের কোন কেয়ার নেই।
আরে বাবা! টিকেটের মধ্যে যে সিট নাম্বার দেয়া আছে তা দেখে তো আসল জায়গায় বসা যাবে।
তাহলে এত ধাক্কাধাক্কির দরকার কি? নাকি হলগুলোতে টিকেটের নাম্বার আছেই সার, সিটের কোন নাম্বার নেই!
কি জানি, আমি কোনদিন হলে যাইনি। তাই বলতেও পারব না।
হলের দর্শক সব ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম বোরখা পড়া কয়েকজন মেয়ে আর মহিলা ঘোরাফেরা করছে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক।
হঠাৎ বোরখা পড়া এক মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ নাড়া দিল।
আমিতো হতবাক। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আমার সামনে এসে বলল- কি লাগব নাকি?
আমি বললাম- কত?
-হোটেল ভাড়া সহ পাঁচশ টাকা।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ইতঃস্তত করলাম। তারপর বললাম- দেড়শ টাকা দিব।
-কি? মেয়েটি শুনতে না পেরে আবার প্রশ্ন করল।
-দেড়শ টাকা।
-হাউয়ার পোলা, দেড়শ টাকা দিয়া মাগী খাইতে আইছস! যা ভাগ এহান তে।
আমি তাড়াতাড়ি মান-সম্মান নিয়ে সরে পড়লাম। আমি যে ফাইজলামী করছিলাম তা কি মেয়েটা বুঝতে পারেনি? আসলে পারার কথা নয়। কারণ জীবন এদের কাছে অন্যরকম অর্থের হয়ে গেছে। যেখানে নেই কোন হাসি কিংবা ঠাট্টা।
যাক অনেক হয়েছে। আজকে সারাদিন আমি খালি ঘুরেছি আর ঘুরেছি। এবার বাসায় যেতে হবে। ফার্মভিউ সুপার মার্কেট হতে একটা লাচ্ছি খেয়ে গলা জুড়ালাম। তৃষ্ণায় মনে হচ্ছিল ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হওয়া শুরু হল। সারাদিনের ব্যস্ততার পর ঢাকার ক্লান্ত মানুষগুলো ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। আমিও একটা মিরপুরের বাস পেয়ে উঠে পড়লাম।
বিঃদ্রঃ এটি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখা হয়েছে।
সমাপ্ত
“আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই”
মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই জেগে উঠলাম আমি । সকাল ৭টা বাজে । মুখ ধুয়ে, নাস্তা খেয়ে বাংলাবাজার যেতে হবে । আমার উপন্যাস বের হবে কয়দিন পর । উপন্যাসের নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ ও ‘নাজু’ । কিন্তু সমস্যা হল আমার বাসা মিরপুরে, আর মিরপুর থেকে বাংলাবাজার যাওয়া মানে ঢাকা মেট্রপলিটন শহরের প্রায় পুরোটাই ঘুরে যাওয়া । আমি ছাত্র মানুষ, প্রথমদিকে উপন্যাস বের করার মত টাকা যোগাতে পারিনি ।
তাই বলে থেমে থাকিনি কিন্তু, বহুজন ও বহু প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করেছি ।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশের দৈনিক প্রথম আলো থেকে শুরু করে যত রকম ছোট-বড় পত্রিকা, ম্যাগাজিন রয়েছে তাদের অধিকাংশকেই বিরক্ত করেছি বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ই-মেইল পাঠিয়ে । এমন কি ব্যাঙ্ক,প্রাইভেট কোম্পানী, চ্যাট রুম, টিভি চ্যানেল এবং রেডিও চ্যানেলও বাদ রাখিনি ।
আমি সবার কাছে একটাই মেইল পাঠাতাম, তা হল এরকম-
Dear Sir,
I am Md.Arafat Hossain, student of Bashir Uddin Adarsha School & College in class-10. I am from Dhaka,Mirpur-1. By the way, I am a writer & I have written some proletereiet novel, such as- “ Meghna Nodir Tire, Narir Kanna, Jiboner Ontorale etc. But I have no capital to publish this novel. Please help me to publish my novel. Your help can be climbed me in the top position in the socity, specially in the literery world. You can contact with me at this number.
Mobile: 01671-856966
মোটামুটি এই ধরনের মেইল পাঠাতাম সকলকে । আর এই মেইল পাঠিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী বিরক্ত করেছি দৈনিক প্রথম আলো-কে । ফলশ্রুতিতে তাদের অফিস থেকে দুই/তিনবার বাসায় ফোন করে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে ।
যাই হোক, এজন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট হতে ক্ষমা প্রার্থী ।
তো, উপন্যাস বের করার জন্য আমি প্রকাশক সাহেবকে পাক্কা পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি । আর সবচেয়ে আজব বেপার হল, আমি গিয়েছিলাম আমার এক পরিচিত লেখক সাগর আঙ্কেলের সাথে । পরে জানতে পারলাম উনি আমার দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক হাজার টাকা দালালী খেয়েছেন । একথা জেনেছি আমি প্রকাশক সাহেবের কাছ থেকে ।
মোট কথা, জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম যে উপন্যাস ছাপাতে গেলেও দালালী খাওয়া হয় ।
আসল কথায় আসি এবার । নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম বাংলাবাজার যাওয়ার জন্য ।
মাকে বললাম- আম্মু, পঞ্চাশটা টাকা দাওতো, বাংলাবাজার যাব ।
-বাংলাবাজার যেয়ে যেয়ে তুই এ পযর্ন্ত কত টাকা খরচ করেছিস হিসাব আছে ? উপন্যাস ছাপিয়ে করবি টা কি শুনিতো ? সংসারে এত অভাব কি তুই চোখে দেখিস না ? এক কেজি করে চাল আনি, মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে হলুদ-মরিচ আনি । এতো অভাব চোখে দেখেও তুই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেছিস উপন্যাস বের করতে । আরে বাংলাদেশে কি লেখকের অভাব আছে ? তারাও তোর মত আশায় আছে উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হবে । কয়জন সফল হয়েছে দেখাতে পারবি ?
একটানা ক্ষোভের সাথে মা কথাগুলো বলে গেলেন । আমার দুঃখে বুক ফেটে কান্না বের হতে চাইল । আল্লাহ আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বানিয়েছেন । আমদের মত মানুষ সমাজে না পারে টাকার অভাবে নিচু কোন কাজ করতে, না পারে টাকার অভাবে কোন সচ্ছল ব্যবসা করতে । আমাদের এ পাশ কিংবা ও পাশ হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই । কারন মধ্যবিত্ত বলে আমরা একই সাথে সমাজের সকলের সাথে চলাফেরা করি । তাইত মান-সম্মান আর ইজ্জতের মুল্য আমরাই বেশী বুঝি ।
আমি মনে মনে বললাম-দেখো মা, তোমার ছেলে ঠিকই একদিন উপন্যাস লিখে খ্যাতির দোড়গোঁড়ায় পৌছে যাবে । মুখে বললাম- দাও না আম্মু, পঞ্চাশ টাকাই তো । আর মাত্র দুইবার যাব । তারপর উপন্যাস বের হয়ে যাবে, প্লিজ দাও ।
মা কিছু বললেন না, বেরিয়ে গেলেন । আমি জানি, এই পঞ্চাশ টাকা মা পাশের ঘরের সানির মার থেকে ধার করে আনবেন । মা তো মা ই, তাই এত কথার পরও আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলেন, আর বললেন- রাস্তাঘাটে সাবধানে যাস ।
-ঠিক আছে আম্মু, বলে ঘর হতে বেরিয়ে এলাম আমি । আমরা যে ফ্লাটটায় থাকি সেখানে মোট চারটি রুম । এক রুমে সানীরা, আর এক রুমে গামের্ন্টসে চাকরি করা স্বামী-স্ত্রী, আর একটায় ফ্লাটের মালিকের দোকানের কমর্চারী এবং আর একটায় আমরা থাকি ।
আমি এখন নিজের বুঝ বুঝি । এখনত আর বাবা-মার সাথে এক ঘরে, এক খাটে শোয়া যায় না । তাই আমার মা কর্মচারীদের খাটের পাশে আরেকটা পুরোন খাট ফেলেছে বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে । তবে এজন্য মাসে ছয়শ টাকা দিতে হবে । সকালে বাড়িওয়ালার কর্মচারীরা দোকানে যায়, আসে রাত এগারটায় । এর মাঝে আমি অবসর কাটাই সেই খালি রুমে । রচনা করতে চেষ্টা করি সাহিত্যগাথা, উপন্যাস, ছোট গল্প কিংবা কবিতা ।
মিরপুর-১
বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর-১ এর বাস স্ট্যান্ডে আসতে আমার অনেক সময় লাগল । এর কারণ হল প্রচন্ড জ্যাম ।
না, এই জ্যাম কোন যানবাহনের নয় ।
এ জ্যাম মানুষের জ্যাম ।
ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে হতে শুরু করে রাজপথ পযর্ন্ত সবর্ত্রই তাদের চলাফেরা,
তারা হল গামের্ন্টস কর্মী ।
সকাল বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে, কি এক মহা প্লাবনের ন্যায় আসছে তারা ।
এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে তাদের আসতে দেখা যায় ।
তাদের সম্পর্কে একেক জনের একেক মত ।
বাড়িওয়ালারা বলে- ঢাকা শহরটাকে নরকবাস বানিয়ে ছাড়ল গামের্ন্টস কর্মীরা ।
প্রশাসন বলে- দেশের অধিকাংশ খারাপ কাজ হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মী দ্বারা ।
জননেতারা বলেন- দেশের পোষাক শিল্পের মেরুদন্ড তারা ।
সাধারণ মানুষ বলে- ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় আর এবং জোটবদ্ধ বাহিণী হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মীরা ।
কিন্তু আমি বলি অন্য কথা । ওরা কত স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে নিজেদের গ্রাম-পরিবার ফেলে এই হিংস্র কসাইখানার শহর ঢাকায় এসেছে । দু’মুঠো খাবে, কিছু সঞ্চয় করবে পরিবার ও নিজের জন্য । হয়তো কঠিন কিন্তু অদূরে দন্ডায়মান বাস্তব ভবিষ্যতের জন্য ।
এত কিছুর মাঝেও তারা স্বপ্ন দেখে ।
সে স্বপ্ন একাকী নয় । আরেকজনকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন । তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অন্যরকম এক সমাজ । সে সমাজেও আছে প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি ।
কিন্তু তাদের এ সমাজ সভ্য সমাজের স্বীকৃতি হতে বঞ্চিত ও অবহেলিত ।
সকালে যখন গামের্ন্টস শুরু হয় এবং যখন রাতে ছুটি হয়, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু কমর্হীন বাউন্ডুলে ছেলে আর রিক্সাওয়ালারা ।
মেয়েদের দেখলে তারা শিস্ দেয় ।
রিক্সাওয়ালারা মুচকি মুচকি হাসে ।
অনেক সময় তাদের রিক্সার নিয়মিত যাত্রী হয় গামের্ন্টস কর্মীরা ।
রিক্সাওয়ালা তার কল্পিত মাসির্ডিজ গাড়ি নামের রিক্সায় রাজকন্যা নামের গামের্ন্টস কর্মীকে নিয়ে ছুটে চলে ।
যাই হোক, বাসস্ট্যান্ডে পৌছে দেখি সিটিং বাসে টিকিটের স্বল্পতা চলছে, আর লোকাল বাসে চলছে বাঁদড় নাচের প্রতিযোগিতা । কে কত সুন্দরভাবে বাঁদড় নাচ নাচবে, তার উপর ভিত্তি করে বাসে অবস্থান দৃঢ় হবে ।
অগত্যা আমিও বাঁদড় নাচের প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম ।
সকালের মিষ্টি রোদ আর মিষ্টি লাগছে না । বাস ছাড়তেই হঠাৎ ১ নাম্বারের এক মহিলা পাগলী চিৎকার শুরু করল- ওই ড্রাইভার, প্রধানমন্ত্রীরে ফালাইয়া কই যাস ? জলদি আমারে নিয়া যা ।
বলে কাপড়-চোপড় খুলে দিগম্বর হয়ে মহিলা পাগলী বাসের পিছনে দৌড়ানো শুরু করল । ততক্ষণে বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে ।
আহহা বেচারী, আমি আফসোস করি । কোন এক সময় সে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিল । তা না হলে এভাবে কোন মহিলার ব্রেন আউট হওয়ার প্রশ্নই আসেনা ।
কিন্তু তার মার্কা কি ছিল ? পাটগাছ, না জাহাজ মার্কা ?
সন্দেহে পড়ে যাই আমি ।
শ্যামলী
‘ওই হল শ্যামলী, হল শ্যামলী নামেন ।’ চিৎকার করে যাত্রীদের আহ্ববান করে হেল্পার ।
আমি জিগ্যেস করলাম- আচ্ছা ভাই, হল কই ?
হেল্পার আমাকে সামনে দেখিয়ে বলল- ওই যে ।
-কই হলতো নাই ।
-কি জানি, বলে মাথা চুলকাতে লাগল হেল্পার ।
আমি একজনের সিটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । লোকটা শ্যামলীতে নেমে গেল । আমি জ়ায়গা পেয়ে বসে গেলাম । সামনে অসংখ্য যানবাহন । সব শ্যামলীর সিগন্যালে আটকেছে । আমি সিটে বসে উশখুশ করতে লাগলাম । প্রচন্ড রোদের তাপে ঘর্ম স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সকলের গাত্রদাহ থেকে । তারওপর আবার বাসের ছাঁদ লোহার তৈরি । তাই গরম যেন শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকছে । এছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা দু-চারজন লোকের ঘাম বেয়ে বেয়ে চট করে আমার হাতে বা রানে পড়ছে ।
খুবই অস্তত্বিকর অবস্থা । আমার রুমাল মনে হয় আর ঘাম শুষতে পারছে না । ইতিমধ্যেই ভিজে ঢোল হয়ে গেছে রুমাল ।
এর মধ্যে ভিড় ঠেলে একজন ঠোঙা হাতে ঢুকল ।
-ভাইসব, আসসালামু আলাইকুম । বেশী কথা বলে বাচাল আর ক্যাম্পাসার । আমি কোনটাই না । তাই আপনাদের অনুরোধ করে বলছি যে একবার এই দাঁতের ঔষুধটা ব্যবহার করে দেখুন । দাঁতের পোকা থেকে ময়লাসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিবে । দাম লিখা আছে বিশ টাকা, কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছা সৌজন্যে এর দাম নিচ্ছি মাত্র দশ টাকা, দশ টাকা, দশ টাকা ।
বাংলাদেশের বড় বড় ডেন্টিস্টরা পাঁচশ টাকা, এক হাজার টাকা ভিজিট নিয়েও এই ঔষুধটা দিয়ে থাকেন । তাই আর দেরী না করে একবার এই ঔষুধটা ব্যবহার করুন এবং আপনার অমুল্য দাঁত বাঁচান । কে দিবেন দশ টাকা আমাকে ?
বলে সকলের দিকে তাকাল ঔষধ বিক্রেতা ।
দুই-চারজন কিনলও । এরমধ্যে সবুজ বাতি জ্বলে উঠল । বাস দ্রুত গতিতে এগোন শুরু করল ।
হেল্পার আমাকে জিগ্যেস করল- কই যাইবেন ভাই ?
-গুলিস্তান ।
-১২ টাকা দেন ।
-১২ টাকা দিব কেন ? আমি ছাত্র না ? রাগ করেই বলি আমি ।
-আইচ্ছা ৮ টাকা দেন ।
আমি আট টাকা দিলাম । বাস ততক্ষণে শ্যামলী ছেড়ে যাচ্ছে ।
সংসদ ভবন
সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছে বাস । বাম পাশে সংসদ ভবন । হঠাৎ মৃদু কাশি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল বাসের ইঞ্জিন । বার কয়েক স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল ড্রাইভার । এতেও যখন কাজ হল না, তখন হেল্পার দুজন আর অতি উৎসাহি চারজন যাত্রী বাস ধাক্কা দেয়া শুরু করল ।
কতক্ষন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল ড্রাইভার । যাত্রীদের প্রাপ্য টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বাসের ইঞ্জিন ঠিক করা শুরু করল ।
আমি সংসদ ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম । সংসদ ভবনের বিশাল এরিয়ার ফুটপাথে সারি সারি চটপটি আর চা-কফি সিগারেটের দোকান । আমি চটপটির চলমান টঙের দোকানের নাম পড়া শুরু করলাম ।
রংপুর চটপটি হাউজ, বরিশাল স্পেশাল চটপটি, পাবনা চটপটি বেকারী, চাঁদপুর নাইট-ফাইট উড়া-ধূড়া চটপটি ।
নাম পড়ছিলাম আর এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যেন যাচ্ছিলাম । তাদের নামের বাহারের প্রশংশা করতে হয় ।
এই পেশার মাধ্যমে এক শ্রেণীর নিম্নবিত্ত লোক তাদের সংসার চালাচ্ছে ।
না, তাদের কাস্টমার কোন মন্ত্রী-এমপি নয় । তাদের কাস্টমার হল সংসদে ঘুরতে আসা আমার মত সাধারণ মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভবঘুরে ।
আমি সংসদের গেইটের দিকে এগোতে লাগলাম । আকাশের কোথাও এক ফোটা মেঘের চিহ্ন নেই । দিগন্তের উধ্বর্মুখ হতে যেন নরকের আগুন প্রবাহিত করছে সূর্য্যমামা । রোদের তীব্রতায় পিচঢালা পথও মনে হয় গলে যাচ্ছে ।
এরি মাঝে কুলি আর শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করছে শুধু দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য ।
আমি সংসদ ভবনের সীমানায় প্রবেশ করতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করল- কোথায় যাবেন?
-কোথাও না, এমনিই ঘুরাঘুরি করছি ।
-আজকে ঘোরা যাবে না । সংসদের অধিবেশন শুরু হবে একটু পর ।
-ও। (আমি বোঝার চেষ্টা করি। )
হঠাৎ একটা কথা মনে হতে দাড়োয়ানকে আমি প্রশ্ন করি- আচ্ছা চাচা, আপনি কোন দল করেন? পাটগাছ মার্কা, না জাহাজ মার্কা?
-আমি কোন মার্কাই না । শালা-শালীরা বদমাইশ । (দাড়োয়ানের মুখে ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে )
-কেন কেন? আমি প্রশ্ন করি ।
-আরে যখন যেই দল ক্ষমতায় আইব, হেই দল সংসদের অধিবেশনে এমন সব ওয়াদা করব যেসব ওয়াদা হেগো বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির মধ্যে কেউ করে নাই ।
-ওইটা কোন সমস্যা না চাচা । মিথ্যা ওয়াদা ছাড়া রাজনীতি হয় না । এই যেমন এই কাজটা আপনি পারেন না দেখেই তো আপনি সংসদের দাড়োয়ান । যদি পারতেন, তাহলে সংসদে আপনার নামে আলাদা সিট থাকত ।
-হ ভাইস্তা, আপনি ঠিকই কইছেন ।
-আচ্ছা চাচা, আমি চলি ।
বলে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । একটু পর একটা গুলিস্তানের বাস পেয়ে গেলাম । তাও কানায় কানায় ঠাসা । ফার্মগেটে গিয়ে শুরু হল জ্যামের প্রতিযোগিতা ।
কোন রাস্তায় বেশী জ্যাম থাকবে তারই প্রতিযোগিতা । রোদের তাপ বাসের ধাতব শরীরে পড়ায় গরম যেন চরম হয়ে দ্বিগুন পরিমানে লাগছে ।
কাওরাণ বাজারের কাছে আসতেই আল্লাহ যেন মুখ তুলে চাইলেন ঢাকাবাসীকে । হঠাৎ আকাশ জুড়ে কাল-সাদা মেঘ । কিছুক্ষণ প্রচন্ড বাতাস হল । এরপরেই নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ।
পল্টন
এখন সকাল ১০টা বাজে । বাস পল্টনে থামতেই নেমে পড়লাম । এখানে একটু কাজ আছে । একটা পার্ট-টাইম জবের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছি ।
বড় একটা বিল্ডিং-এর নিচে দাঁড়ালাম । চারতলায় বড় করে ব্যানারে লেখা ডেসটিনি-২০০০ লিঃ ।
আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল । লিফট দিয়ে সাততলায় উঠলাম । ছয় নম্বর রুমের কাছে এসে ফোন দিতেই আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল একটা ছেলে ।
কাঁচের দরজা । ভিতরে এসি চলছে । পাঁচটা টেবিলে আট-দশজন মানুষ কাজে ব্যস্ত । একটা টেবিলের সামনের একটি মেয়ে আমাকে বসতে বলল ।
-আপনিই আরাফাত?
-জ্বি । (জবাব দিলাম আমি)
-আমাদের এখানে জব করার জন্য আপনাকে ছোট একটা কাজ করতে হবে । পারবেন আপনি?
-ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই পারব ।
-Good, আপনাকে সেলারি দেয়া হবে ৫,০০০ ৳ মাসে । এজন্য আপনাকে ২০ টাকা দিয়ে এই ফরমটা পূরণ করতে হবে আর ৫১৫ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ।
-তাহলেই কি আমার চাকরী শুরু? (বললাম আমি)
-না, এরপর আপনাকে এই ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে একজন বীমাকারীকে ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করাতে হবে । তাহলে আপনি চাকরীতে পামার্নেন্ট হবেন । এখন ফরমটা কি আমি পূরণ করে দিব?
-No Thanks, রাগ চেপে মুখে হাসি নিয়ে বললাম আমি ।
-আচ্ছা, রেজিস্ট্রেশন ফি আপনার জন্য কমিয়ে দিচ্ছি ।
-যদি পারেন পুরোটাই কমান, তা না হলে আমি আসি ।
-আচ্ছা ঠিক আছে, যান এটা মওকুফ করা হল । কিন্তু বীমাটা আপনাকে করাতে হবে ।
-বীমা করালে কি হবে?
-এখন ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করালে আপনি ২ বছর পর ৫০,০০০ টাকা পাবেন ।
-আচ্ছা, আপনাদের কোম্পানীর নাম কি? (আমি সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলাম)
-মুনলাইট ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিঃ ।
-শালীর ঘরের শালী । মনে মনে গাল দিয়ে উঠি আমি । মুখে বললাম- আপনাদের এই বীমা কোম্পানীর নাম জীবনের ফার্স্ট শুনলাম ।
-আসলে এটি নতুন এসেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তো । এর নাম পরে আরও শুনবেন ।
-আচ্ছ ঠিক আছে, পরে যখন আরও শুনব, তখন এসে না হয় চাকরীতে যোগদান করে যাব । (বলেই হনহন করে হেঁটে বের হয়ে এলাম)
--আমাদের চাকরীর পোস্টটা কিন্তু পরশু দিনের মধ্যেই ভরে যাচ্ছে ।
বের হতে হতে শুনলাম মেয়েটার এই শেষ বাক্য ।
গুলিস্তান
আবারও জ্যাম, আবারও সেই প্রচন্ড রোদ । রোদ দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে । গুলিস্তানের কাছাকাছি এসেছি। বাসের ভিতর একের পর এক ছোট-খাট বিক্রেতারা বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ঢুকছে ।
একজন এসে বলল- ওই ঠান্ডা পানি লন । মাত্র ১০ টাকা এক বোতল । লগে একটা চকলেট ফিরি (ফ্রি) ।
চকলেটের জন্য নয়, গলা ভেজানোর জন্য অনেকেই পানি কিনল । আমিও কিনলাম একটা ।
একটু পর এল রুমাল বিক্রেতা- ওই রুমাল লন, ঘাম মুছেন । জোড়া ১০ টাকা, একটা পাঁচ টাকা ।
এরপর এল আইসক্রীম- এই গরমে, ঠান্ডা খান আরামে ।
আমি এদের ব্যবসার টেকনিক দেখে অবাক হয়ে যাই । কি চমৎকারভাবে প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের চাহিদার পরিবতর্ন অনুযায়ী এরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে । আসলে দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতেই তাদের এত ধান্দা-ফিকির করতে হয় । জীবনের নিমর্মতা তাদেরকে করেছে দুরভিসন্ধী ও সুযোগ সন্ধানী ।
গুলিস্তানে এসে পড়েছি, কিন্তু এত জ্যাম । রাস্তা পার হব কি করে । যেদিকে তাকাই শুধু রিক্সা,বাস,প্রাইভেটকারের বাজার বসেছে ।
ট্রাফিক পুলিশ এক হাতে লাঠি আর এক হাতে সুই নিয়ে এগিয়ে এল । এসেই সমানে রিক্সাওয়ালাদের পিঠে গায়ের জোর দিয়ে বাড়ি মারতে লাগল আর সুই দিয়ে টায়ার ফুটা করে দিতে লাগল ।
যেন বিদ্রোহী জনতাকে দমন করছে দাঙা পুলিশ ।
ট্রাফিক পুলিশের ধারণা রিক্সাওয়ালাদের ভাগাতে পারলেই শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের যাতায়াতের একমাত্র বাহণ যে রিক্সা এ কথা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে চায় না
মাজারের অপর পাশ হতে ডাকছে টমটম ঘোড়ার গাড়োয়ান- ওই সদরঘাট আহেন ১০ টাকা, সদরঘাট আহেন ১০ টাকা ।
আমি টমটমে চড়ে বসলাম । মানুষ ভরে যেতেই ঘোড়া চলা শুরু করল । ইংলিশ রোডে আবার প্রচন্ড জ্যাম ।
আমি ঘামে ভিজে প্রায় গোসল করে ফেলেছি ।
হঠাৎ দেখি এক লোক রিক্সাওয়ালার কলার ধরে টানছে। হেঁচকা টান দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে সে রিক্সা হতে নামাল ।
‘ভাড়া বেশী চাইছস কেন? ’ বলেই সজোড়ে চটোপাঘাত করল রিক্সাওয়ালাকে ।
-ভাই ভুল হইছে ভাই, মাফ কইরা দেন । বলে রিক্সাওয়ালা পা ধরে ফেলল লোকটার ।
সামনে কতগুলো স্মার্ট মেয়ে গাড়িতে বসেছিল ।
বিধাতার কি অপুর্ব নিয়ম! রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেকের শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়, আবার অনেকে গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে এসির বাতাস খায় ।
এই হিংস্র নিষ্টুর শহরে কেউ কাউকে দয়া, ভিক্ষা কিংবা করুণাও করেনা ।
একটু সামনে গিয়ে দেখি আরেক ছেলে রিক্সাওয়ালাকে কলার ধরে নামিয়েই ধাম করে ঘুষি বসিয়ে দিল মুখে। ঘুষির চোটে রিক্সাওয়ালার নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসল।
এবার রিক্সাওয়ালা উঠে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে বেসামাল করে দিল। তারপর সেও কয়েকটা ঘুষি চালিয়ে দিল ছেলেটার নাকে-মুখে।
গরীব আর অসহায় বলে ওরা কি সব সময় অত্যাচার আর মারধোর ভোগ করবে?
না, ওরাও এক সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠে যখন অত্যাচারের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে যায়। এসময় সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠেল। আমাদের টমটম এগিয়ে চলল সদরঘাটের পথে।
বাংলাবাজার
ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১২ টা বাজে। সদরঘাট আর বাংলাবাজার-এর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছি।
সোজা হাটা শুরু করলাম বাংলাবাজারের গলির ভিতর। পাঁচ মিনিট পর পৌছে গেলাম গন্তব্যস্থলে।
সত্যকথা প্রকাশনী
বড় করে লেখা রয়েছে উপরে। আমি ভিতরে ঢুকে প্রকাশক সাহেবকে সালাম দিলাম। উনার নাম রণি আহমেদ।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?
-এইতো ভালই, আমার উপন্যাস বের হবে কবে?
-ভাই আপনিতো বাংলাবাজার থাকেন না, দিনের মধ্যে চৌদ্দ-পনের বার লোডশেডিং হয়। এ কারণে আমাদের প্রকাশণীর কাজ খুব স্লো ভাবে চলছে।
-এখন ভাই আপনিতো জানেনই যে আমি এই উপন্যাস প্রথম আলো পত্রিকায় জমা দিব। সময়তো বেশী নেই। তাড়াতাড়ি করেন না একটু। (আমি প্রকাশক সাহেবকে সমস্যা বোঝাই)
-আইচ্ছা যান, তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করব।
-তো আসি ভাই। বলে বিদায় নিয়ে আসলাম। প্রকাশকের সাহেবের পাশের রুমে কয়েকজন ছেলে বসে রয়েছে। এদের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন লেখক মানুষ।
খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি আর বড় বড় বাবরি চুল। অনেকে কানে রিঙও পড়েছে। কাঁধেও ব্যাগ ঝুলানো রয়েছে।
একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম। সাধারণ পোষাক, স্লিম ফিগার, ক্লিন সেভড আর সাদা চশমা পড়া এক ইনোসেন্ট বয়।
অবশ্য চশমা খুললে নাকি আমাকে শয়তান শয়তান বলে মনে হয়। (আমার বন্ধুদের কথা)
একজন লেখককে প্রশ্ন করলাম।
-ভাই আপনার কি কোন উপন্যাস বের হচ্ছে?
-হ্যাঁ, উপন্যাসের নাম ‘তোমার মরণ হলে আমারও মরণ হবে’ । এই যে দেখুন বই। আমি বইটি হাতে নিলাম, প্রচ্ছদে শাবনূর আর শাকিব খানের ছবি। কিন্তু ছবির নায়ক-নায়িকার নাম লিখা আছে রিয়াজ আর পূণির্মা। আমি বেশ অবাক হলাম, কিন্তু কিছু বললাম না।
-আমার নাম শ্যামল। এই নিন, বইটা আপনাকে উপহার দিলাম।
-অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার একটা বই বের হচ্ছে, নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ । বইটি অবশ্যই আপনি নিয়ে যাবেন।
-জ্বি অবশ্যই।
আরেকজন লেখকের সাথে কথা বললাম।
-ভাই, এটিকি আপনার বই?
-জ্বি, এই যে দেখুন।
আমি দেখলাম বইয়ের নাম ‘রঙিলা মাইয়া’ ।
-আপনার আর কোন বই বের হয়েছে? (প্রশ্ন করলাম আমি)
-অনেকগুলো, এই যেমন- ‘সুন্দরী মেয়ে, রসিয়া বন্ধু, পীরিতের আগুন, গরীবের ভালবাসা, রক্ত দিয়ে প্রেমের শুরু ------------
-থাক আর বলতে হবে না, আপনিতো তাহলে একজন খ্যাতিমান লেখক।
আমার কথায় যেন সে লজ্জা পেল। বলল
-না, তা এখনো হতে পারিনি, তবে হয়ে যাব শীঘ্রি।
আর একজন লেখকের দিকে এগোলাম। পরনে জিন্সের প্যান্ট, পেস্ট কালার গেঞ্জি। মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, হাতে ব্রেসলেট আর কানে ব্লুটুথ।
বড় লোকের ছেলে, তাকালেই বোঝা যায়।
-ভাই কি লেখক নাকি?
প্রশ্ন করতেই সে যা শুরু করল আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পাগল নাকিরে বাবা? আমায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে চেয়ারে বসাল সে। তারপর তার কাঁধের ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করল।
তাতে তার লিখা উপন্যাসের নামের তালিকা। কমপক্ষে এক হাজার হবে।
নামের বৈচিত্রও ভিন্নরকম। যেমন-
১. পাগলা মামু,
২. ন্যাঙটা বাবা,
৩. ট্যানাড়ির ভূত,
৪. ছাগলনাইয়া,
৫. ভেড়ামারার মরা ভেড়া,
৬. সেক্রোসাইনিস্টের দেশে ................. ইত্যাদি
নামের তালিকা আমার হাতে দিয়ে ছেলেটা বলল,
-দেখুন, এগুলো সব আমার লিখা উপন্যাস। এগুলোর প্রায় সবগুলো বুকার, পোকার, নোভেল প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন প্রাইজ পাচ্ছিনা কেন বলতে পারেন?
আমি ছেলেটার জন্য আফসোস বোধ করলাম। আসলে হওয়ারই কথা। লাখ-লাখ টাকা খরচ করে এত উপন্যাস বের করছে, অথচ কোন স্বীকৃতি পাচ্ছে না। বললাম
-আপনি বরং এক কাজ করুন, এসব উল্টো-পাল্টা কাহিণী না লিখে গ্রাম বাংলার মানুষ ও সমাজকে নিয়ে কিংবা জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা নিয়ে লিখুন, যেখানে জীবনের ঘটনা সহজে ফুটে উঠবে।
-কি বললেন আপনি? আমি উল্টা-পাল্টা কাহিণী লিখি?
ছেলেটার চোখ-মুখ গরম হয়ে ভয়ানক আকৃতি ধারণ করল। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম
-না, মানে আপনার এই বিখ্যাত অত্যাধুনিক সাহিত্যগাঁথা বেশী বড় তো! এক কাজ করুন, আরও ছোট করে বের করুন, তাহলে লোকে পড়বে। আর আপনিও পুরস্কার জিতবেন।
ছেলেটা মনে হয় এবার কিছুটা শান্ত হল। আমি তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে এলাম। এরকম মাথা গরম লোকের সামনে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।
ধানমন্ডি
দুপুর ২টা বাজছে। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ১০ মিনিট হেঁটে নিউমাকের্ট পৌছলাম। ওভার ব্রিজের পাশের মাকের্টে বেশ কয়েকটা হোটেল। আমি রাস্তার পাশে ছোট একটা হোটেলে ঢুকলাম।
আমি যে হোটেলে বসেছি তার পাশেই একটা আবাসিক হোটেল। উপরে নাম লিখা- ‘হোটেল গ্যালাক্সি প্রাঃ লিঃ ’।
একটু পর পর দেখি একেকজন ঢুকে আর বের হয়। এত তাড়াতাড়ি তারা কি করে বুঝতে পারলাম না। আমি ভাত খেয়ে আবাসিক হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দাঁড়োয়ান বলল,
-কি ভাই, লাগব?
-কত কইরা?
-দেশী মদ ২৫০,ভদকা ৬০০, হুইস্কি ৮০০, আর শ্যাম্পেন ৩০০০ টাকা।
-পুলিশে দেখবো নাতো ভাই?
-আরে কি কন, ধানমন্ডি থানার পুলিশ আমগো পকেটে।
আমি থ হয়ে গেলাম। এই কাজেও প্রশাসনের সহযোগিতা?
আমি চলে যেতে নিচ্ছিলাম, দাঁড়োয়ান প্রশ্ন করল,
-কি ভাই নিবেন না?
-না ভাই। বলে দ্রূত সরে পড়লাম।
ধানমন্ডিতে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে। হঠাৎ তারা এক মোটর সাইকেল আরোহীকে থামাল। আরোহী অল্প বয়সী এক ছেলে।
পুলিশ অফিসার বলল- এই ছেলে, তোমার হুন্ডার কাগজ পত্র আছে?
-জ্বি আছে।
-কই দেখি বের কর।
ছেলেটা লাইসেন্সের ফটোকপি বের করল।
পুলিশ অফিসার বলল- তোমার লাইসেন্সে সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। এই কারণে তুমি ফটোকপি সাথে রাখছ। তোমার বয়সও এখন কম। কাজেই তোমার হুন্ডা চালানো বেআইনী হয়েছে। এখন তুমি কি বল?
-কি বলছেন আঙ্কেল! আমার বয়স ১৯, তাছাড়া আমার লাইসেন্সও ঠিক আছে।
-না না, তোমাকে এখন হুন্ডার সাথে থানায় যেতে হবে। (বলে মুচকী হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল অফিসার)
ছেলেটা সবই বুঝতে পারল। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করল। পুলিশ অফিসার টাকা নিয়েই সাথে সাথে পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বলল,
-আচ্ছা ঠিক আছে, যাও সমস্যা নেই। কিন্তু এরপর থেকে সাবধানে হুন্ডা চালাবে।
ছেলেটা মাথা কাত করে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে মিশে গেল ঢাকা শহরে।
আমি এতক্ষণ অবাক হয়ে দৃশ্যগুলো দেখছিলাম। বাহ! বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ করা জনগণের বন্ধুরা(পুলিশ) যে জনগণের এত কাছে পৌছে যাবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। পৌনে তিনটা বাজে। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
একটা সিএনজি ডাক দিলাম
-এই সিএনজি, কাওরাণবাজার যাবেন?
-যামু।
-চলেন।
-ভাড়া কইলাম ১০০ টাকা।
-কেন কেন? মিটারে যাবেন না?
-না।
-আচ্ছা থাক যাব না। (বললাম আমি)
-মিটারেরতে বিশ টাকা বেশী দিবেন?
-না, দশ টাকা বেশী দিব।
-আইচ্ছা লন।
আমি উঠে বসলাম সিএনজিতে।
জ্যামে আটকা পড়তেই একটি ছোট মেয়ে এগিয়ে এল। হাতে কয়েকটা ফুল। বলল- ভাইজান, একটা ফুল নেন না।
-কত করে ফুল?
-দুইডা দশ টাকা।
-আচ্ছা, দুইটা দাও।
আমি দশ টাকা বের করে দিলাম। ফকিরকে কিছু দান করার চেয়ে এদেরকে দেয়াই ভাল। কারণ ফকিররা বিনা শ্রমে হাত পেতে নিতে চায়। আর ওরা পরিশ্রম করে তার বিনিময়ে দু মুঠো খেতে চায়। ওদের অবশ্য বাড়ি-ঘর নেই। রাতের ঢাকা শহরে বের হলে দেখা যায় ওদের বাসস্থান। রাস্তাই ওদের ঘর, ওদের বিশ্রামখানা, খেলার স্থান। ওদের কখনো সৌভাগ্য হয়নি কোন ছাউনির নিছে একটি রাত ঘুমিয়ে কাটাবার।
সরকার ও নেতা/নেত্রীদের সুদৃষ্টি হতে বঞ্চিত ওরা। তারপরও ওদের কোন আফসুস নেই, নেই কোন অভিযোগ।
কাওরাণবাজার
পম-পম...........পম
ঝক-ঝক, ঝক-ঝক, ঝক-ঝক।
হুইসেল দিয়ে তীব্র গতিতে কমলাপুর স্টেষন থেকে ছুটে আসা বিশাল আন্তঃনগর ট্রেন কাওরাণবাজার রেলগেট অতিক্রম করল। ট্রেন চলে যেতেই রেলগেট উঠিয়ে দিল লাইনম্যান। আবার চলাচল শুরু হল ট্রাক, গাড়ি, রিক্সা, সিএনজি ইত্যাদি।
বামপাশেই তেজগাঁও রেলস্টেষন। একটা লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পাশের লাইনে বিশাল এক মালগাড়ি।
আমি যাব ডানপাশে, একটা রেললাইন মোড় নিয়েছে চাল-ডালের গুদামের দিকে। ওই গুদামের ডান পাশেই আমার খালুর বাসা। এখন চারটা বাজে। সূ্যর্টা প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঘিঞ্জি আর দূষণযুক্ত ঢাকা শহরে। আমি লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
এই লাইনে ট্রেন আসে মাসে দুই এক বার। চাল-ডাল বা শষ্যাদি নিয়ে যায় অথবা দিয়ে যায় মালগাড়ি। দুই পাশে ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষের সারি সারি বস্তি ঘর।
ঘরগুলো বেড়া, নীল মোটা পলিথিন আর বাশের সাহায্যে বানানো হয়েছে। অধিকাংশ ঘরেই কোন চৌকি বা বিছানা নেই। তবে রেডিও কিংবা টেলিভিশন আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই আছে। শিশুগুলো উলঙ্গভাবে খেলা করছে লাইনের উপরে। অলস, ক্লান্ত আর অবসন্ন বৃদ্ধরা লাইনের উপর বসে উদাসভাবে চেয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ কিংবা বর্ষার প্রবল বষর্ণ এখন আর তাদের স্পর্শ করেনা। কারণ জীবন যুদ্ধে তারা পরাজিত সৈনিক।
বস্তিবাসীরা ঘরের ভিতরই রান্না করে। তাদের পায়খানার ব্যবস্থাত খুবই করুণ। বিভিন্ন ময়লা-আবজর্না তারা লাইনের উপরই ফেলে। অনেকে অভাবের তাড়নায় যে রেললাইনের দুই একটা স্লিপার বা নাট-বল্টু চুরি করেনা তা নয়। বরং এর জন্য তারা বিবেকের কাছে অপরাধী।
এছাড়া আর কিই বা করার আছে তাদের। ক্ষুধার জ্বালা যখন পেটে সৃষ্টি হয়, তখন মনতো আর মানে না।
নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। আমি এসব দৃশ্য দেখছিলাম আর লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। প্রচন্ড উৎকট দুগর্ন্ধ চারপাশে। কিন্তু এর মধ্যে বেঁচে থাকার অভ্যাস তাদের আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি খালুর বাসায় উপস্থিত হলাম।
খালু আমাকে দেখে বেশ খুশী হলেন। আমি সালাম দিয়ে খালুর কুশলাদি জিগ্যেস করলাম।
খালু বললেন- আইজকা এফডিসির শুটিং হইছিল আমগো গুদামের ভিতরে।
-তাই নাকি! আপনিও কি অভিনয় করেছেন?
-হ, (খালু মুচকি হাসি দেন) আমার রোল আছিল নায়ক শাকিব খানরে একটা চাউলের বস্তা উঢাইয়া দিমু।
-ভাল,(আমি মন্তব্য করি)। আচ্ছা খালু, এফডিসি কোন জায়গায়?
-এহান থিকা রেললাইন দিয়া সোজা হাইটা গেলে প্রথমে যে রোড পড়ব, হেই রোডের বাম সাইডে গেলেই এফডিসি পাবি।
কিছুক্ষণ পর খালু আমাকে ঘরে বসিয়ে বাইরে গেলেন। আমি একা একা উশখুশ করছিলাম, হঠাৎ দরজার বাইরে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল।
-কাকা কোথায়?
-কাকা, মানে আমার ইউনুস খালু?
-জ্বি।
-উনি একটু বাইরে আছেন। কোন সমস্যা? (আমি জানতে চাইলাম)
-না না, এমনিই। আচ্ছা, আপনি উনার কি হন?
-আমি উনার কি হই তাতো আমি বলতে পারব না, তবে উনি আমার খালু হন।
-ও, তার মানে আপনি উনার শ্যালিকার ছেলে।
-জ্বি, আপনি বেশ বুদ্ধিমতি তো! ঠিক ধরে ফেলেছেন।
আমার কথা শুনে মেয়েটা খিক খিক করে হেসে উঠল।
-আপনার হাসিটা বেশ চমৎকার, তবে আরো চমৎকার আমার চাচাত বোন মৌসুমির হাসি।
-তাই নাকি? (সহাস্যে বলল মেয়েটা)
-জ্বি
-আপনি কিন্তু আমাকে সূক্ষভাবে ইনসাল্ট(অপমান) করার চেষ্টা করছেন।
-স্যরি,যাই হোক আপনার নামটা শুনতে পারি?
-জ্বি অবশ্যই, আমি দিনা। ক্লাস টেইন-এ পড়ছি ত্বেজগাঁও হাই স্কুলে। আপনি?
-আমি মোঃআরাফাত হোসেন, এবার এসএসসি পাস করলাম। বতর্মানে মিরপুর কলেজে ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছি। পাশাপাশি আমি একজন শখের লেখক এবং সাহিত্যিক।
-ওরে বাবা, আপনার পদতো অনেক বিশাল! (মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল)
আমি মৃদু হাসলাম। কোন কিছুই আমার জীবনে সুখ দিতে পারবে না, যদি মৌসুমি আমার জীবনে না আসে।
মুখে বললাম- হয়তো বা। আচ্ছা, আপনি খালুর কি হন?
-আমি এ বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে। বাসা স্কুলের পাশেরই একটা বিল্ডিং এর তিনতলায়। মাসে মাসে আমিই ভাড়া উঠাতে আসি।
-আপনার বাবা?
মেয়েটা আমার কথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক শক খেল।
-বাবাতো নেই। মারা গেছেন, মানে মারা হয়েছে। তেজগাঁও-এর সন্ত্রাসীরা আমার বাবাকে গুলি করে মেরেছে। আমার বাবার অপরাধ ছিল তিনি একটা খুনের চাক্ষুশ স্বাক্ষী ছিলেন। যাক বাদ দিন এসব কথা। আপনার বাসা কোথায়?
-আমার বাসা মিরপুর-১ নাম্বারে।
এর মধ্যে খালু এসে উপস্থিত হলেন। হাতে পোটলার ভিতর পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা।
-আরে দিনা, কখন আইছ তুমি?
-এইত কাকা, কিছুক্ষণ আগে।
-বস বস, (বলে খালু চেয়ার এগিয়ে দিলেন)।
দিনা চেয়ারে না বসে আমার সাথে বিছানার এক পাশে বসে পড়ল।
খালু একটা বাটিতে পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা ঢেলে দিলেন।
খালু পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দিনাকে বললেন- ও হইল আমার শালির পোলা।
খালুর কথা শুনে আমি আর দিনা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
-খাও, খাও না কেন তোমরা? (বলে খালু বাটি এগিয়ে দিলেন মাঝখানে)
-খালু আমি একটু এফডিসিতে যাব।
-যাইস, মাগরিবের আজান দিয়া লউক। টাকা আছেনি তোরতে? একশ টাকা লাগব কইলাম ঢুকতে।
-কেন কেন? টাকা লাগবে কেন এফডিসিতে ঢুকতে? ওটা কি চিড়িয়াখানা না জাদুঘর যে টাকা লাগবে?
-দাড়োয়ান টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না। (বোঝালেন আমাকে খালু)
-আশ্চর্য! (অবাক হই আমি) জনগণের টাকায় যারা বেঁচে আছে তারাই কিনা জনগণকে টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না!
-আমাগো সোহাগে গেছিল না। লগে আরও দুইজন আছিল। তিনজনেরতে দাড়োয়ান দুইশ টাকা রাখছে।
-আচ্ছা, টাকা লাগলে দেখা যাবে।
-এইল একশ টাকা (খালু আমাকে টাকা দিতে চান) ।
-আরে করেন কি খালু? আমার কাছে টাকা আছে তো।
-এফডিসির কথা এত জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি কি এখন এফডিসিতে যাবা? (দিনা প্রশ্ন করল)
আমি লক্ষ্য করলাম ও আমাকে আপনি থেকে তুমি করে বলা শুরু করেছে।
-হ্যাঁ, এখনই যেতে চাই।
-চল, আমি তোমাকে এগিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দেই। খালুর নিকট হতে বিদায় নিয়ে এসে পড়লাম। এফডিসি দেখে ফার্মগেট ঘুরে তারপর মিরপুর যাব।
দুই মিনিট পর আমরা রেললাইনে এসে উঠলাম। আমি আর দিনা পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
শেষ বিকেলের মৃদু রোদের আভা দিনার গায়ে পড়ছে। তাতে ওর ফর্সা ভরাট মুখটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। নীল রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়া, কাজলটানা মায়াবী দুই চোখ, আকর্ষণীয় হ্রদয়কাড়া হাসি সাধারণের মাঝেই অত্যন্ত অসাধারণ এবং চমৎকার একটি মেয়ে।
যেকোন ছেলেকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দিনা।
হঠাৎ দিনা বলল- আরাফাত, তোমার হাতটা একটু ধরব?
-ধর।
কিছুক্ষণ নিরিবিলি হাঁটা। আবার প্রশ্ন করল দিনা- আচ্ছা তুমি কি কাউকে ভালবাস?
-হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।
দিনা মৃদুভাবে শিউরে উঠল। বলল- কাকে?
-আমার আপন চাচাত বোন মৌসুমিকে।
-সেকি তোমাকে ভালবাসে?
-না।
-আশ্চর্য! তোমাকে ভালবাসে না?
-বললাম তো, না।
-কখনও কি ভালবাসেনি? আবার প্রশ্ন করে দিনা।
-হ্যাঁ বেসেছে, মানে বাসেনি। ইয়ে ভালবেসেছে নাকি ভালবাসে নি তা এখনও বলতে পারব না। তবে ওকে যখন আমি প্রেম নিবেদন করেছিলাম, তখন ও গ্রহণ করেনি। পরে করল, তাও একটা শর্ত। এস.এস.সি পাস করতে হবে। আমি আস্তে আস্তে ওর প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে গেলাম। মৌসুমিও দুর্বল হয়ে পড়ল আমার প্রতি। ভালবাসার স্বপ্ন, আশা আর কল্পনার জাল বুনতে শিখাল ও আমাকে।
তারপর, তারপর হঠাৎ একদিন আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে বলল- “আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি যা কিছু করেছি তোমার সাথে, তা ছিল আমার অভিনয়। এমন কি তোমাকে জড়িয়ে ধরা, তোমার সাথে কিস (চুম্বন) করা এগুলোও ছিল আমার অভিনয়ের অংশ। তোমার সাথে অভিনয় না করলে তুমি এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে না। তুমি আমাকে ভুলে যাও, কারণ আমি ফয়সাল নামের আরেকজনকে ভালোবাসি।”
আমি খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু মৌসুমি আমার কান্নার মুল্য দেয়নি। আমার কষ্ট একটাই। কেন ও আমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাল? ভালোবাসার নামে কেউ কারো সাথে অভিনয় করে? তাও আবার আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে।
-পাষন্ড ডাইনী, মন্তব্য করল দিনা।
-খবরদার দিনা, আমি গর্জে উঠলাম। মৌসুমিকে নিয়ে কোন বাজে কথা আমার সামনে বলবে না।
-ও আচ্ছা, স্যরি, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও আমাকে।
আমি দিনার চোখের কোণে পানি দেখতে পেলাম। আমার হঠাৎ ভিষণ মন খারাপ হল। বাপ মরা মেয়েটাকে আমি ধমক দিয়েছি মৌসুমির কারণে।
ডানহাত দিয়ে দিনার চোখের কোণ হতে পানি মুছে দিলাম।
-স্যরি, তুমি কাঁদছ কেন? আসলে আমি একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম।
দিনা আমার বুকে মাথা রেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল।
আমি ওকে সান্তনা দিতে লাগলাম। দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর আমাদের পাশ কাটালো একটি আন্তঃনগর ট্রেন।
-বিশ্বাস কর, তোমার মত ভাল ছেলে আমি আগে কখনও দেখিনি। কেন জানি তোমাকে আমার ভাল লেগে গেছে।
-তুমি ভুল ভাবছ দিনা। আমি তেমন ভাল ছেলে নই। আমার মধ্যেও শয়তান বাস করে। তাছাড়া আমি মৌসুমিকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারব না। এটা আমি ওর কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছি।
-কিন্তু ওই মেয়েটাতো তোমাকে বুঝতে পারছে না।
-তুমি কিচ্ছু ভেবনা। দেখবে আমার মৌসুমি একদিন ঠিকই আমার কাছে এসে হাজির হবে।
-আরাফাত?
-কি দিনা?
-সন্ধ্যা হয়েছে, আমাকে চলে যেতে হবে। তোমার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দাও।
-লেখ 01917-592041 , মিসকল দিলেই হবে।
-সে আমি দেখে নিব। এবার দয়া করে আমাকে বিদায় দাও।
-ঠিক আছে এসো।
দিনা চলে যাওয়ার সময় বলল- আবার এসো।
-আচ্ছা আসব।
• এফডিসির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। বিশাল সাইনবোর্ডে লাল-নীল আলোয় লিখা আছে ;
‘BFDC’
এফডিসির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সকলে অধীর আগ্রহের সাথে গেটের ফাঁক দিয়ে এফডিসির ভিতরে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয় নায়ক-নায়িকা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যদি একটু সামনা সামনি চক্ষুদর্শণ করা যায়।
অধিকাংশই গার্মেন্টস কর্মী, কুলি-মজুর আর ছোট-খাট খুচরা ব্যবসায়ী।
সাধারণ জনগণের সময় কোথায় যে তাদের কাজ-কর্ম ফেলে বাংলাদেশের পৃথিবী কাঁপানো সুপারস্টারদের দেখতে আসে!!
তাইতো নায়ক-নায়িকা, পরিচালকরা আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবার সাথে মুড দেখাতে পারেন না। দেখালেও দেখান গার্মেন্টস শ্রমিক কিংবা কুলিদের সাথে।
এক জায়গায় দেখতে পেলাম আট-দশটা ছেলে এফডিসির দাড়োয়ানের সাথে দর কষাকষি করছে।
আমি তাদের সামনে দাঁড়ালাম।
দাড়োয়ান বলছে- দশজন ঢুকবেন, একদাম এক হাজার টাকা দিবেন।
ছেলে- ভাই পাঁচশ রাখেন না।
-না না কম হবে না। ঢুকলে ঢুকেন, নেয়লে যান গা।
ছেলেগুলো বিমর্ষ মুখে আরো তিনশ টাকা বের করে দাড়োয়ানকে আটশ টাকা দিল। ভিতরে ঢুকে ছেলেগুলো এমনভাবে তাকাতে লাগল যেন জান্নাত দর্শণে এসে পড়েছে।
আমি অবাক হলাম এ দৃশ্য দেখে। নায়ক-নায়িকাদের প্রতি তাদের এত ভালবাসা!
নাকি গোটা উঠলে পাছা যেমন চুলকায়, এও তাদের এমন এক চুলকানি।
এফডিসি ঘুরব, তাও কিনা দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে ঢুকতে হবে। আমি কিছুক্ষণ পায়চারি শুরু করলাম। দোকান থেকে একটা বেনসন সিগারেট কিনে মুখে ধরালাম। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে মুড নিয়ে সোজা এফডিসির ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে ঢুকে আমার বেশ আত্নতৃপ্তি হল।
প্রথমে একটা নিচতলা ছোট বিল্ডিং, তারপর লাল একটা বহুতল বিল্ডিং। তার সামনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের বিভিন্ন নির্দেশনা ঝুলানো রয়েছে।
পুরো চত্বর ঘুরেও আমি মিডিয়ার কোন পরিচিত লোক দেখতে পেলাম না। সম্ভবত সন্ধ্যার অনেক পরে এসেছি বলে হয়তো।
বিকালে আসলে নিশ্চয়ই দু-চারজন নায়ক-নায়িকা দেখতে পেতাম।
বাংলার নায়ক-নায়িকাদের আমার মনে হয় যেন চিড়িয়াখানার জন্তু। লোকে কত শখ করে দাড়োয়ানকে টাকার টিকেট দিয়ে তাদের দেখতে আসে।
দশ মিনিট ঘুরে ফিরে আমি এফডিসি হতে বের হলাম। সাথে সাথেই দশ-বারজন ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এফডিসির মাস্তান নাকিরে বাবা?
মোবাইল আর টাকায় হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেই একটা ছেলে আমাকে বলল- ভাইজান, একটু এদিকে আহেন।
-কেন ভাই, কি হয়েছে?
-আহেন না ভাই, বলে আমাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই এফডিসির বামপার্শস্থ একটা দোকানে বসাল।
ছেলেটা বলল- কি খাইবেন ভাই, গরম না ঠান্ডা?
-ঠান্ডা মানে, আমাকে কেন খাওয়াবেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
-ওই হাফ লিটার মোজ়ো দেও তো। দোকানীকে বলল ছেলেটা।
আমার এক হাতে মোজ়ো আর এক হাতে চা।
-ভাই কি সিগারেট খান?
-বেনসন খাই, মানে, কেন ভাই?
সে জবাব দেয় না। এবার হাতে চায়ের সাথে বেনসন সিগারেটও এসেছে।
আমি অবাক হই। এরা খাওয়াচ্ছে কেন আমাকে!
-ভাই, আমার নাম আইউব। নারায়ণগঞ্জ গার্মেন্টসে কাজ করি। ভাইয়ে কি করেন?
-আমার নাম মোঃ আরাফাত হোসেন, পড়াশোনা করছি। বাসা মিরপুর এক নাম্বারে।
-ভাই ঝালমুড়ি খাইবেন?
-ঝালমুড়ি? আমি মুখ দিয়ে প্রশ্ন করতেই আইউব অর্ডার দিয়ে দিল। হ্যাঁ কিংবা না বলার প্রয়োজন পড়ল না।
-দশ টাকার মুড়ি দেওতো ভাইরে। সুন্দর কইরা বানাইয়া দিও।
আইউব অর্ডার দিয়ে ফেলে।
আমি চুপচাপ খাবার খেতে থাকি। এদের আচরণে মনে হচ্ছে না যে এরা চোর-বাটপার। বরং মনে হচ্ছে এরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ।
কিছুক্ষণ পর আইউব আমাকে প্রশ্নগুলো করল- ভাই আপনে ভিতরে ঢুকছেন কেমনে? আপনে কি সিনেমার কোন লোক? নাকি আপনের পরিচিত কেউ আছে? আমরা কি কি ভিতরে ঢুকতে পারমু না?
ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন।
আমি চোখ হতে চশমাটা নামিয়ে বললাম- আস্তে ভাই,আস্তে। আমি ভিতরে ঢুকেছি পায়ে হেঁটে, আমি সিনেমার কোন লোক না, আমার পরিচিত কেউ এই ঢালিউডে মানে সিনেমায় নেই এবং আপনারাও ভিতরে ঢুকতে পারবেন।
-কই দাড়োয়ানতো ভিতরে ঢুকতে দেয় না।
-দাড়োয়ানের কাছ থেকে আপনারা অনুমতি নিতে যান কেন? আমিতো কারো অনুমতি নেই নি। সামান্য একজন দাড়োয়ান কিভাবে আপনাদের থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়?
আমার এ কথার জবাব কেউ দিতে পারল না।
আরো ঘন্টাখানেক আইউব আর তার বন্ধু-বান্ধবদেরকে উপদেশ ঝাড়লাম।
বিদায় নিয়ে হাযির হলাম ফার্মগেটে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত আটটা চল্লিশ বাজে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ফার্মগেটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে। অদূরেই বিখ্যাত আনন্দ সিনেমা হল। উপরে বিশাল এক টিভি সেট করা। তাতে একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে।
এই মূহুর্তে পুরো ফার্মগেটে বাস,ট্রাক,রিক্সা,গাড়ি,মোটর সাইকেল প্রভৃতির ছড়াছড়ি। সারাদিনের কাজ-কর্মের পর মানুষ নীড়ে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আনন্দ সিনেমা হলের সামনে যেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। এই মুহূর্তে ছবির টিকেট বিক্রি হচ্ছে হলের কাউন্টারে। ছবির নাম- “ স্বামী কেন আসামী ”।
কয়েকশ মানুষ টিকেট কেনার জন্য কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
অধিকাংশই শ্রমিক কিংবা রিক্সাওয়ালা। কারণ আজকাল এরা ছাড়া বাংলা ছবি কেউ খুব একটা দেখে না।
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে গেল। অনেকেই এতে ক্ষেপে গিয়ে হাঙামা শুরু করল। হলের দাড়োয়ান যেইমাত্র হলের দড়জা খুলে দিল, অমনি সবাই একসাথে হট্টগোল আর চেঁচামেচি করে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকতে লাগল।
আমি বিস্ময়ের সাথে এসব দৃশ্য দেখছিলাম। অনেকে হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে যেয়ে মোটামুটি ব্যথা পেল। কিন্তু সেদিকে তাদের কোন কেয়ার নেই।
আরে বাবা! টিকেটের মধ্যে যে সিট নাম্বার দেয়া আছে তা দেখে তো আসল জায়গায় বসা যাবে।
তাহলে এত ধাক্কাধাক্কির দরকার কি? নাকি হলগুলোতে টিকেটের নাম্বার আছেই সার, সিটের কোন নাম্বার নেই!
কি জানি, আমি কোনদিন হলে যাইনি। তাই বলতেও পারব না।
হলের দর্শক সব ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম বোরখা পড়া কয়েকজন মেয়ে আর মহিলা ঘোরাফেরা করছে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক।
হঠাৎ বোরখা পড়া এক মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ নাড়া দিল।
আমিতো হতবাক। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আমার সামনে এসে বলল- কি লাগব নাকি?
আমি বললাম- কত?
-হোটেল ভাড়া সহ পাঁচশ টাকা।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ইতঃস্তত করলাম। তারপর বললাম- দেড়শ টাকা দিব।
-কি? মেয়েটি শুনতে না পেরে আবার প্রশ্ন করল।
-দেড়শ টাকা।
-হাউয়ার পোলা, দেড়শ টাকা দিয়া মাগী খাইতে আইছস! যা ভাগ এহান তে।
আমি তাড়াতাড়ি মান-সম্মান নিয়ে সরে পড়লাম। আমি যে ফাইজলামী করছিলাম তা কি মেয়েটা বুঝতে পারেনি? আসলে পারার কথা নয়। কারণ জীবন এদের কাছে অন্যরকম অর্থের হয়ে গেছে। যেখানে নেই কোন হাসি কিংবা ঠাট্টা।
যাক অনেক হয়েছে। আজকে সারাদিন আমি খালি ঘুরেছি আর ঘুরেছি। এবার বাসায় যেতে হবে। ফার্মভিউ সুপার মার্কেট হতে একটা লাচ্ছি খেয়ে গলা জুড়ালাম। তৃষ্ণায় মনে হচ্ছিল ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হওয়া শুরু হল। সারাদিনের ব্যস্ততার পর ঢাকার ক্লান্ত মানুষগুলো ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। আমিও একটা মিরপুরের বাস পেয়ে উঠে পড়লাম।
বিঃদ্রঃ এটি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখা হয়েছে।
সমাপ্ত
মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০১০
কৃষ্ণকেশীর রক্তকেলী
জানিনা কি অপরাধ করেছিলাম আমি যে নিজের জীবনের কাহিণী আজ আমাকে গল্প হিসেবে লিখতে হচ্ছে। তবুও লিখছি,শুনুন তবে।
যৌবন তখন আমার সবে শুরু হয়েছে। মনের ভিতর আশ্চর্য এক নিঃস্বঙ্গতা। চার মাস পর এস.এস.সি পরীক্ষা,তবুও কোরবানীর ঈদে বাড়ীতে গেলাম। দীর্ঘ তিন বছর পর দেখতে পেলাম সোনালি রোদ্দুরের আলোয় স্নিগ্ধ রূপের সেই মায়াবতীকে, আমার আপন চাচাতো বোন।
ওরাও পুরোন ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে। অতিরিক্ত চঞ্চল, বয়সে আমার চেয়ে এক বছর ছোট। তবে কৃষ্ণকেশ এবং সুডৌল উন্নত রূপের পাশাপাশি কুচকুচে কাল মায়াবী হরিণীর মত চোখের কল্যাণে পৃথিবীর সমস্ত কৌশল ওর নখদর্পণে।
সম্পর্কটা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আমি যদিও চাচা-চাচীর কথা ভেবে একটু দমে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওর সাহসিকতার কাছে সেই সব নস্যাৎ হয়ে গেল।
আর সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের মত সুযোগ পেলে বাসা থেকে বের হয়ে ডেটে যাওয়া হয়নি আমাদের। হয়েছে বাসায় যেয়ে দেখা করা শুধু। যখনি চাচা-চাচী বাসায় থাকতেন না তখনি ও আমাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলত। ক্রমে আমার এস.এস.সি পরীক্ষার পড়াশোনা শিকেয় উঠল। সারাক্ষণ কৃষ্ণকেশীর কথা,কিভাবে অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করব সেই সব আবেগময় স্বপ্ন।
এর মাঝে আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। আব্বা-আম্মা যেতে দিতে চাইলেন না।
আমি জোর করে গেলাম,কারণ কৃষ্ণকেশী আসছে বিয়েতে।
রাতের লঞ্চে উঠেও মূহুর্তের জন্য দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না তার কথা ভেবে।
ভোরবেলা ফুপুর বাসায় যেয়ে দেখি সবাই যখন ঘুমাচ্ছে,সেই সময় ও আমার জন্য চুপিসারে বসে আছে ফুপুদের পাশের ঘরে। ঘটনা তখন আমার আর সব ফুপাতো এবং চাচাতো ভাই-বোনেরা জেনে গেছে। তারা সবাই আমাদের দুইজনকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণকেশী আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকদিন দেখা হয়নি তো আমাদের তাই।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম,আমার চোখটা ভিজা মনে হতে হাত দিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, পানি ঝড়ছে।
প্রথমে আলতো হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। ভারী আশ্চর্য তো! আমার বুকে কিসের যেন এক সীমাহীন প্রশান্তির যন্ত্রনা শুরু হল। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে গেল সারা দেহে।
শিহরণের প্রচন্ড ধাক্কায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল।
একি আশ্চর্য অনুভূতি প্রেমের!
আমি দু’চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণকেশীকে দুইহাতে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় করতে লাগল, এই সুখ হারিয়ে গেলে আমি হয়তো বাঁচব না। আলতো করে কৃষ্ণকেশীর মাথা ধরে উপরে উঠালাম।
প্রথমে মৃদু কাঁপুনি ছাড়া কিছুই হল না। তারপর কম্পিত ভঙ্গিতে আস্তে করে প্রশস্ত ভরাট কপালে একটি চুমু এঁকে দিলাম।
কথা দাও,(আমি ফিসফিস করে বললাম) কোনদিন আমাকে ভুলে যাবে না!
ও অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে আমি সারা পৃথিবীর সরলতা আর পবিত্রতা দেখতে পেলাম।
কৃষ্ণকেশীর দু’ঠোট ফাঁক হয়ে আছে কিছু বলার জন্য। প্রথম কয়েক মূহুর্ত সে কথা বলতে পারল না আবেগের কারণে।
তারপর মাথাটা আমার বুকে এলিয়ে দিল সে। আমার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে আনল
-আমি শুধু তোমার।
এ সময় ঝড়ের বেগে আমার চাচা ঘরে ঢুকলেন। আমরা তখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছি।
তিনি একটা কথাও বললেন না। সাড়াশীর মত ডানহাত দিয়ে থাবা দিয়ে নিজের মেয়েকে ছিনিয়ে নিলেন আমার কাছ হতে। আমি কোন কিছু অনুভব করতে পারলাম না ঘটনার আকস্মিকতায়।
সেই রাতেই চাচা-চাচী প্রাইভেট কার ভাড়া করে চলে গেলেন। সমস্ত আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে যারা বাকী ছিল তারাও আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেল। সবাই আমাকে ভীষন অপদার্থ মনে করতে লাগল। আমার কারণে চাচা-চাচী বিয়ে বাড়িতে কোন রকম সামাজিক কর্ম সমাধা না করেই চলে গেলেন।
বিয়ে শেষে আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। ওইদিন আমার ফুপাতো ভাই আমাকে ফোন করে জানাল যে কৃষ্ণকেশী আমার জন্য কেঁদে কেঁদে নিজেকে নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছে।
আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমিও আব্বা-আম্মার দিক হতে এ নিয়ে প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছি। একমাস বাকী পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার। এর মধ্যে একদিন সুযোগ এসে গেল।
কৃষ্ণকেশী আমাকে জানাল যে তাদের বাসায় কেউ নেই,আমি যেন এক্ষুনি চলে আসি।
বিশ মিনিটের ভিতর আমি তৈরি হয়ে নিলাম। আমাদের বাসা মিরপুর-১ থেকে সিএনজিতে উঠে ঘন্টা দেড়েকের ভিতর আমি তার বাসায় পৌছে গেলাম। ঘর তখন পুরো খালি,শুধু আমার ফুপাতো বোন জোহরা আপা ছিলেন তাদের বাসায়। আপা জানালেন সে একটু মার্কেটে গেছে।
খানিকবাদে দরজায় বেল পড়তে আমি দৌড়ে গিয়ে হুড়কো খুলে দিলাম।
কৃষ্ণকেশী দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় ক্লান্ত এবং মৃদু ঘামের ছাপ। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য স্নান সমাপ্ত মেয়েটি এসে হাজির হয়েছে।
নজরেতে চাহি মোর পলক নাহি পড়ে,
লোকে তারে কাল বলি সদা ব্যাঙ্গ করে।
নিজ দেহ,নিজ বস্ত্র জগৎ জোড়া ভাল,
মোর প্রিয়া মোর কাছে প্রদীপসম আলো।
আমি নিজের রচিত একটি কবিতা মনে মনে আউড়িয়ে গেলাম। তারপর কৃষ্ণকেশীর চোখে চোখ রাখলাম। সেখানে মৃদু রাঙ্গা আভা আর খুশীর ঝিলিক দেখতে পেলাম। ধীর স্থির ভঙ্গিতে এক হাত দিয়ে টেনে ওকে আমার শরীরের কাছে টেনে আনলাম। ও পরম নির্ভরতায় আমার বুকে মাথা গুজে চোখ বন্ধ করল।
আমরা ড্রইং রূমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ওর জন্য বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে আরচিজ (ARCHIZ) থেকে একটা নেকলেস আর পায়ের নূপুর কিনেছিলাম। নিজ হাতে ওকে পড়িয়ে দিলাম আমি। ও ভীষন খুশী হল।
প্রায় চার ঘন্টা পার হয়ে গেল কি করে, তা আমি বুঝতেই পারলাম না।
বিদায় নিতে যেয়ে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল।
শেষ মূহুর্তে যাওয়ার সময় ও কান্না জড়িত কন্ঠে আমাকে বলল- আরাফাত, তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর প্লিজ। তা না হলে আব্বা-আম্মা আমাকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে।
বলে কাঁদতে কাঁদতে ও আমার পায়ে পড়ে গেল।
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বুকের পাথরটাকে জাকিয়ে বসার সুযোগ দিলাম। ভাঙ্গা গলায় বললাম- আমার এস.এস.সি পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপরই আমরা বিয়ে করব,তুমি কোন চিন্তা অথবা কান্নাকাটি করো না।
শেষ কথাটি বলতে আমার বুক ফেটে কান্না আর হাহাকার বেড়িয়ে এল- তুমি একদম কাঁদবে না। তাহলে যে আমি নিজেকে টিকিয়ে রাখার কোন সান্তনাই পাব না।
বলে আর দাঁড়ালাম না। সোজা হেটে রাস্তার মাথায় চলে আসলাম। বাঁক নেওয়ার সময় শেষবার ক্ষনিকের জন্য পেছন দিকে তাকালাম। সেখানে কৃষ্ণকেশীর মাথায় জোহরা আপা আদর মাখা সোহাগ বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণকেশী নির্বাক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ভরা শ্রাবণের বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে দু’চোখে।
আমার হঠাৎ একটা কথা ভেবে ভাল লাগল নিজের কাছে। আর কেউ না হোক, আমার আত্নীয় ভাই-বোনরা তো আমাদের সাথে আছে!
দেড় মাস পরঃ
কাল আমার কম্পিউটার পরীক্ষা। তারপরই এস.এস.সি-এর ঝামেলা শেষ। কতদিন কথা হয়না কৃষ্ণকেশীর সাথে হিসাব করলাম আমি। দীর্ঘ একমাস পঁচিশ দিন।
পরদিন পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র তাকে কল করলাম আমি।
-বিজি।
আবার কল করলাম পাঁচ মিনিট পর।
-বিজি।
ঘটনা কি? আমি একটানা সতের বার কল করার পর তারপর ওকে পেলাম। কল রিসিভ করল ও।
-হ্যালো, কেমন আছ আরাফাত?
আগের মতই রূপকথা জগতের সুরেলা কন্ঠ। কিন্তু সেই কন্ঠে ভালবাসার ছিটেফোটা নেই। আমি বললাম
-আগামীকাল বিকেলে রমনা পার্কে এসো।
-স্যরি, সময় হবে না কালকে। আর আমি আসব কেন? তোমার দরকার হলে তুমি আমাদের বাসায় এসো।
বিদ্যুতের মত আমার মাথায় যেন হাজার ভোল্টের বাজ পড়ল।
-এ কি ধরনের কথা বলছ তুমি জ্বান?
-জ্বান? (আমার কন্ঠকে ব্যাঙ্গোক্তি করল ও) আমি তোমার জ্বান আবার কবে থেকে হলাম!
নিখাদ বিস্ময় ঝড়ে পড়ল ওর কন্ঠে।
-দেখো মৌসুমি, আমার সাথে ফাজলামি করো না প্লিজ। কাল তোমার সাথে গুরুত্ব পূর্ণ কথা আছে।
-তুমি বোধহয় শুনতে পাওনি। যাক,আবার বলছি স্যরি, কাল আমার সময় হবে না মোটেও। কাল আমাদের বাসায় ফয়সাল আসছে।
অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল কৃষ্ণকেশী।
-তুমি কি আমার প্রতি রাগ করেছ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি কৃষ্ণকেশীকে।
-রাগ? তোমার সাথে? তুমি আমার এমন কি হও যে তোমার সাথে আমি রাগ করব।
“আমাকে তুমি ভালবাস” বলতে যেয়েও বললাম না। বললাম
-এই কি আমাদের কথা ছিল মৌসুমি?
-দেখ আরাফাত, কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত ঝড়ে পড়ল ওর। তোমার সাথে সম্পর্কটা ছিল আমাদের দুইজনেরই জীবনের একটা মস্ত ভুল। এ সম্পর্ক আমাদের পরিবার মেনে নিবে না। তার চেয়ে তুমি আমাকে ভুলে যাও। আর তুমি কলেজে উঠলেই দেখবে আমার চেয়ে আরো সুন্দরী মেয়েরা আছে। তোমার আপাতত চলতে কষ্ট হবে না। তাছাড়া তুমি মনে হয় জানো না, আমি ফয়সালকে ভালবাসি। ও জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার আম্মুও ওকে খুব পছন্দ করে। তাহলে শুধু শুধু এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না, টের পেলাম আমি। আমি নির্বাক শ্রোতার মত কৃষ্ণকেশীর কথা শুনতে লাগলাম।
-তুমি বোধহয় ভাবছ তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল তার কি হবে। শুন আরাফাত, তোমার সাথে আমি যদি সম্পর্ক না করতাম, তাহলে এস.এস.সি পরীক্ষায় তুমি পাস করতে পারতে না। সুতরাং আমি যা কিছু করেছি তোমার ভালর জন্যই করেছি।
এরপর অনেক কাঁদলাম আমি।
কখনো একাকী, কখনো ওকে ফোন করে। জোহরা আপা ওকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু ও অনড়।
ওতো সবই বুঝে। আর যে সব বুঝে তাকে বুঝানোর মত সাধ্য কারো নেই। ও পুরোন ঢাকার মেয়ে, আমার চেয়ে অনেক বেশী চঞ্চল আর জেদী।
শুরু হল আমার ভয়ঙ্কর জীবন।
সারাক্ষন মুখে সিগারেট, নিজেকে বিংশ শতাব্দীর দেবদাস মনে হল। এক সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখা হল পাইকপাড়ার আলমগীরের (ছদ্বনাম) সঙ্গে। আমার বাল্যবেলার বন্ধু, কিন্তু ও পড়াশোনা বন্ধ করে নাকি ভয়ঙ্কর কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
আমাকে ডেকে নিল ও। কি করছি, কেমন আছি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল ও। এক পর্যায়ে ওকে কৃষ্ণকেশীর কথা খুলে বললাম। ও আমাকে একটা পুড়িয়া দিল। বলল
-এটা খা, দুনিয়ার শান্তি এর মধ্যে আছে।
আমি কম্পিত হস্তে পুড়িয়াটা খুললাম। ও সেটা দিয়ে গাঁজা বানাল। তারপর আমার হাতে বাড়িয়ে দিল।
বার দুই টান দিয়ে আমার খুকখুক কাশী আসতে লাগল। অসহ্য দুর্গন্ধ!
তবুও আমি জোর করে কষে টান দিলাম স্টিকে। সাথে সাথে মাথা আউলিয়ে গেল আমার।
তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। গাঁজা,মদ,ঝাক্কি,বাশী,ফেনিসিডিল অনেক কিছুই খেলাম।
এক সময় বন্ধু আলমগীর আমাকে কাজে লাগাতে শুরু করল।
যশোর বেনাপোল থেকে আসা অবৈধ অস্ত্র,পেথিডিন,এক প্রকার ট্যাবলেট সব আমি গাবতলী থেকে নিয়ে আসতাম। দুইজন লোক দিয়ে যেত সেই সব। সব নাকি ইন্ডিয়ার মাল।
এক সময় বেশ কিছু টাকা পেলাম হাতে। চিন্তা করলাম কৃষ্ণকেশীর কথা, প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ তাহলে এভাবেই খারাপ হয়!
আমি দ্রূত সিদ্ধান্ত নিলাম। কৃষ্ণকেশীকে আমি তুলে আনব পুরোন ঢাকা থেকে। প্রথমে রেপ করব, তারপর ওকে খুন করব নিজ হাতে।
এলাকার বড় ভাই এবং বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম। বন্ধু আলমগীরকে আগেই বলে রাখলাম যে আমার একটা রিভলবার চাই। ও জিজ্ঞেস করছিল কেন। আমি জবাব দেইনি।
নির্ধারিত দিন আমরা রওনা হলাম সবাই মিলে। পুরোন ঢাকায় পৌছে আমি কৃষ্ণকেশীকে ফোন দিলাম নিচে আসার জন্য। মিনিট পাঁচেক ধাপ্পা মারার পর ও নিচে নেমে এল।
আমার লোকজন তখন সবাই গাড়ির ভিতর।
কৃষ্ণকেশীকে কথা বলতে বলতে গাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। তারপর ও কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরোল ওর গলা দিয়ে। আশেপাশের দু’চারজন মানুষ তখন ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। তাদেরকে বিস্ময়ে রেখেই আমরা গাড়ি নিয়ে সোজা সাভারে চলে এলাম। আমি কৃষ্ণকেশীকে ঠান্ডা গলায় বললাম
-তোমার জন্য তিনটা পথ খোলা আছে মৌসুমি, কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
১. আমাকে বিয়ে করা।
২. তোমাকে ধর্ষন করা।
৩. গুলি করে হত্যা করা।
কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
কৃষ্ণকেশী অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখল।
-তুমিতো এমন ছিলে না আরাফাত। আহহা, তোমার চেহারাটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছ একবার। চল আমাদের এলাকায় গিয়ে আমরা বিয়ে করি। আমিতো শুধু তোমাকেই ভালবাসি।
ঘৃণায় রিরি করে উঠল আমার মন ওর মিষ্টি গলায় ভালবাসার কথা শুনে। আমি আবার পূর্বের কথা পুনরাবৃত্তি করলাম।
ও আগে যেমন অভিমান করলে ফুঁপিয়ে উঠত, ঠিক সেই একই ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল
-তুমি আমাকে যখন একটুও ভালবাস না। তাহলে আমাকে মেরেই ফেল।
আমি চটাশ করে সর্বশক্তি দিয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। এবং তিনটি পথের ভিতর একটি বেছে নেওয়ার কথা বললাম।
থাপ্পরের শব্দে গাড়ির ভিতর সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
এবার ও সরাসরি বলল
-আমি তোমাকে মরে গেলেও বিয়ে করব না।
-গুড, মন্তব্য করলাম আমি। সবাইকে গাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করতে সবাই নেমে গেল। গাড়িটা এখন সাভার পার হয়ে একটা ফাঁকা মাঠের কাছে আছে।
আমি কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করলাম কৃষ্ণকেশীর সাথে। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র এক বছর ছোট, সুতরাং জোর মোটামুটি ভালই আছে ওর শরীরে।
আচমকা আমার দেহের সমস্ত জীদ একসাথে ভর করল আমার মনে। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে বাঁ হাতে কৃষ্ণকেশীর গলা চেপে ধরলাম, একই সাথে সেই হাতের তর্জনী দ্বারা ওর বুকের কিছু কাপড় টেনে নামিয়ে দিলাম। তারপর সুস্থির ভঙ্গিতে ডান হাতে রিভলভারটা মুঠো করে ধরে চোখ বন্ধ করে ওর বুকে নল ঠেকালাম। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই ট্রিগার চেপে দিলাম আমি। ঠাস করে পটকা ফাটার মত তীক্ষ্ণ আওয়াজ হল।
চোখ খুলে কৃষ্ণকেশীর দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় দেখতে পেলাম আমি। গুলি করেই রিভলবার ছেড়ে দিয়ে ওর মাথা ধরে আমার বুকে তুলে নিলাম। আমার হাতে তখন কৃষ্ণকেশীর দেহের ফোটা ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে
-তোকে আমি অনেক বেশী শিক্ষা দিয়ে ফেলেছিরে। তুই কোনদিন আমাকে ক্ষমা করিস না।
বলে ঝড় ঝড় করে আমি হঠাৎ কেঁদে ফেললাম।
ও কথা বলতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ ছাড়া কিছু বের হল না।
আমি ভয়ঙ্কর বিস্ময় নিয়ে দেখলাম গুলিটা ঠিক গলার ভোকাল কর্ডের মাঝামাঝি দিয়ে অতিক্রম করেছে। ছিড়া সেই নালী দিয়ে গলগল করে তাজা লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
অনেক কষ্টে বলে উঠল ও,
-তোমার সাথে আমি যা করেছি তার শাস্তি হিসাবে এটাই উপযুক্ত।
কথাগুলো যেন বহুদূরের কোন গম্বুজ হতে প্রতিধ্বনির মত শুনাল।
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয় গেল আমার জ্বানের কম্পায়মান দেহ। আমার জ্বান মৌসুমি খুন হয়ে গিয়েছে, আমারই গুলিতে।
এতক্ষণ পর, অনেকটা বাংলা ছবির মত আমার বন্ধু আর বড় ভাইরা এল। ঘটনা দেখে সাগর ভাই (ছদ্বনাম) আমাকে বাঁ হাত দিয়ে সজোরে থাপ্পর দিলেন। আমি তখন ঘোর গলায় রিভলবারটা সাগর ভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। ইশারায় আমাকে গুলি করার জন্য অনুরোধ করলাম। জবাবে আরো দু’চারটা থাপ্পর পড়ল আমার পিঠে। সাগর ভাই সর্বশক্তিতে আমার কপালে একটা ঘুষি দিলেন। তারপরই আমি জ্ঞান হারালাম।
কৃষ্ণকেশীর রক্তকেলী শেষ পর্যন্ত আমিই ঘটালাম।
না, আসলে আমি ঘটাই নি।
ও এখনো বেঁচে আছে, পুরোন ঢাকায় গেলে তার দেখা পাওয়া যাবে। গুলি করার বিষয়টি নিখাদ আমার অবচেতন মনের হিংস্র কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে ও আমার সাথে যে প্রতারণা করেছে, তার শাস্তি ওকে পেতে হবে, নিজের ইজ্জত দিয়ে সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে।
আমিতো ভালই ছিলাম। সাহিত্য রচনা, আর ফুল-পাখি নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আমি কিছুই ভাবতাম না। সেই ভাবনাকে যে নষ্ট করেছে তার ক্ষমা নেই।
তবুও তাকে আমি ভালবাসি। হৃদয় থেকে ভালবাসি।
সে শুধু আমারই কৃষ্ণকেশী, আর কারো নয়।
মোঃ আরাফাত হোসেন
যৌবন তখন আমার সবে শুরু হয়েছে। মনের ভিতর আশ্চর্য এক নিঃস্বঙ্গতা। চার মাস পর এস.এস.সি পরীক্ষা,তবুও কোরবানীর ঈদে বাড়ীতে গেলাম। দীর্ঘ তিন বছর পর দেখতে পেলাম সোনালি রোদ্দুরের আলোয় স্নিগ্ধ রূপের সেই মায়াবতীকে, আমার আপন চাচাতো বোন।
ওরাও পুরোন ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে। অতিরিক্ত চঞ্চল, বয়সে আমার চেয়ে এক বছর ছোট। তবে কৃষ্ণকেশ এবং সুডৌল উন্নত রূপের পাশাপাশি কুচকুচে কাল মায়াবী হরিণীর মত চোখের কল্যাণে পৃথিবীর সমস্ত কৌশল ওর নখদর্পণে।
সম্পর্কটা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আমি যদিও চাচা-চাচীর কথা ভেবে একটু দমে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওর সাহসিকতার কাছে সেই সব নস্যাৎ হয়ে গেল।
আর সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের মত সুযোগ পেলে বাসা থেকে বের হয়ে ডেটে যাওয়া হয়নি আমাদের। হয়েছে বাসায় যেয়ে দেখা করা শুধু। যখনি চাচা-চাচী বাসায় থাকতেন না তখনি ও আমাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলত। ক্রমে আমার এস.এস.সি পরীক্ষার পড়াশোনা শিকেয় উঠল। সারাক্ষণ কৃষ্ণকেশীর কথা,কিভাবে অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করব সেই সব আবেগময় স্বপ্ন।
এর মাঝে আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। আব্বা-আম্মা যেতে দিতে চাইলেন না।
আমি জোর করে গেলাম,কারণ কৃষ্ণকেশী আসছে বিয়েতে।
রাতের লঞ্চে উঠেও মূহুর্তের জন্য দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না তার কথা ভেবে।
ভোরবেলা ফুপুর বাসায় যেয়ে দেখি সবাই যখন ঘুমাচ্ছে,সেই সময় ও আমার জন্য চুপিসারে বসে আছে ফুপুদের পাশের ঘরে। ঘটনা তখন আমার আর সব ফুপাতো এবং চাচাতো ভাই-বোনেরা জেনে গেছে। তারা সবাই আমাদের দুইজনকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণকেশী আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকদিন দেখা হয়নি তো আমাদের তাই।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম,আমার চোখটা ভিজা মনে হতে হাত দিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, পানি ঝড়ছে।
প্রথমে আলতো হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। ভারী আশ্চর্য তো! আমার বুকে কিসের যেন এক সীমাহীন প্রশান্তির যন্ত্রনা শুরু হল। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে গেল সারা দেহে।
শিহরণের প্রচন্ড ধাক্কায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল।
একি আশ্চর্য অনুভূতি প্রেমের!
আমি দু’চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণকেশীকে দুইহাতে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় করতে লাগল, এই সুখ হারিয়ে গেলে আমি হয়তো বাঁচব না। আলতো করে কৃষ্ণকেশীর মাথা ধরে উপরে উঠালাম।
প্রথমে মৃদু কাঁপুনি ছাড়া কিছুই হল না। তারপর কম্পিত ভঙ্গিতে আস্তে করে প্রশস্ত ভরাট কপালে একটি চুমু এঁকে দিলাম।
কথা দাও,(আমি ফিসফিস করে বললাম) কোনদিন আমাকে ভুলে যাবে না!
ও অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে আমি সারা পৃথিবীর সরলতা আর পবিত্রতা দেখতে পেলাম।
কৃষ্ণকেশীর দু’ঠোট ফাঁক হয়ে আছে কিছু বলার জন্য। প্রথম কয়েক মূহুর্ত সে কথা বলতে পারল না আবেগের কারণে।
তারপর মাথাটা আমার বুকে এলিয়ে দিল সে। আমার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে আনল
-আমি শুধু তোমার।
এ সময় ঝড়ের বেগে আমার চাচা ঘরে ঢুকলেন। আমরা তখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছি।
তিনি একটা কথাও বললেন না। সাড়াশীর মত ডানহাত দিয়ে থাবা দিয়ে নিজের মেয়েকে ছিনিয়ে নিলেন আমার কাছ হতে। আমি কোন কিছু অনুভব করতে পারলাম না ঘটনার আকস্মিকতায়।
সেই রাতেই চাচা-চাচী প্রাইভেট কার ভাড়া করে চলে গেলেন। সমস্ত আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে যারা বাকী ছিল তারাও আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেল। সবাই আমাকে ভীষন অপদার্থ মনে করতে লাগল। আমার কারণে চাচা-চাচী বিয়ে বাড়িতে কোন রকম সামাজিক কর্ম সমাধা না করেই চলে গেলেন।
বিয়ে শেষে আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। ওইদিন আমার ফুপাতো ভাই আমাকে ফোন করে জানাল যে কৃষ্ণকেশী আমার জন্য কেঁদে কেঁদে নিজেকে নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছে।
আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমিও আব্বা-আম্মার দিক হতে এ নিয়ে প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছি। একমাস বাকী পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার। এর মধ্যে একদিন সুযোগ এসে গেল।
কৃষ্ণকেশী আমাকে জানাল যে তাদের বাসায় কেউ নেই,আমি যেন এক্ষুনি চলে আসি।
বিশ মিনিটের ভিতর আমি তৈরি হয়ে নিলাম। আমাদের বাসা মিরপুর-১ থেকে সিএনজিতে উঠে ঘন্টা দেড়েকের ভিতর আমি তার বাসায় পৌছে গেলাম। ঘর তখন পুরো খালি,শুধু আমার ফুপাতো বোন জোহরা আপা ছিলেন তাদের বাসায়। আপা জানালেন সে একটু মার্কেটে গেছে।
খানিকবাদে দরজায় বেল পড়তে আমি দৌড়ে গিয়ে হুড়কো খুলে দিলাম।
কৃষ্ণকেশী দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় ক্লান্ত এবং মৃদু ঘামের ছাপ। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য স্নান সমাপ্ত মেয়েটি এসে হাজির হয়েছে।
নজরেতে চাহি মোর পলক নাহি পড়ে,
লোকে তারে কাল বলি সদা ব্যাঙ্গ করে।
নিজ দেহ,নিজ বস্ত্র জগৎ জোড়া ভাল,
মোর প্রিয়া মোর কাছে প্রদীপসম আলো।
আমি নিজের রচিত একটি কবিতা মনে মনে আউড়িয়ে গেলাম। তারপর কৃষ্ণকেশীর চোখে চোখ রাখলাম। সেখানে মৃদু রাঙ্গা আভা আর খুশীর ঝিলিক দেখতে পেলাম। ধীর স্থির ভঙ্গিতে এক হাত দিয়ে টেনে ওকে আমার শরীরের কাছে টেনে আনলাম। ও পরম নির্ভরতায় আমার বুকে মাথা গুজে চোখ বন্ধ করল।
আমরা ড্রইং রূমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ওর জন্য বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে আরচিজ (ARCHIZ) থেকে একটা নেকলেস আর পায়ের নূপুর কিনেছিলাম। নিজ হাতে ওকে পড়িয়ে দিলাম আমি। ও ভীষন খুশী হল।
প্রায় চার ঘন্টা পার হয়ে গেল কি করে, তা আমি বুঝতেই পারলাম না।
বিদায় নিতে যেয়ে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল।
শেষ মূহুর্তে যাওয়ার সময় ও কান্না জড়িত কন্ঠে আমাকে বলল- আরাফাত, তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর প্লিজ। তা না হলে আব্বা-আম্মা আমাকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে।
বলে কাঁদতে কাঁদতে ও আমার পায়ে পড়ে গেল।
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বুকের পাথরটাকে জাকিয়ে বসার সুযোগ দিলাম। ভাঙ্গা গলায় বললাম- আমার এস.এস.সি পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপরই আমরা বিয়ে করব,তুমি কোন চিন্তা অথবা কান্নাকাটি করো না।
শেষ কথাটি বলতে আমার বুক ফেটে কান্না আর হাহাকার বেড়িয়ে এল- তুমি একদম কাঁদবে না। তাহলে যে আমি নিজেকে টিকিয়ে রাখার কোন সান্তনাই পাব না।
বলে আর দাঁড়ালাম না। সোজা হেটে রাস্তার মাথায় চলে আসলাম। বাঁক নেওয়ার সময় শেষবার ক্ষনিকের জন্য পেছন দিকে তাকালাম। সেখানে কৃষ্ণকেশীর মাথায় জোহরা আপা আদর মাখা সোহাগ বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণকেশী নির্বাক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ভরা শ্রাবণের বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে দু’চোখে।
আমার হঠাৎ একটা কথা ভেবে ভাল লাগল নিজের কাছে। আর কেউ না হোক, আমার আত্নীয় ভাই-বোনরা তো আমাদের সাথে আছে!
দেড় মাস পরঃ
কাল আমার কম্পিউটার পরীক্ষা। তারপরই এস.এস.সি-এর ঝামেলা শেষ। কতদিন কথা হয়না কৃষ্ণকেশীর সাথে হিসাব করলাম আমি। দীর্ঘ একমাস পঁচিশ দিন।
পরদিন পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র তাকে কল করলাম আমি।
-বিজি।
আবার কল করলাম পাঁচ মিনিট পর।
-বিজি।
ঘটনা কি? আমি একটানা সতের বার কল করার পর তারপর ওকে পেলাম। কল রিসিভ করল ও।
-হ্যালো, কেমন আছ আরাফাত?
আগের মতই রূপকথা জগতের সুরেলা কন্ঠ। কিন্তু সেই কন্ঠে ভালবাসার ছিটেফোটা নেই। আমি বললাম
-আগামীকাল বিকেলে রমনা পার্কে এসো।
-স্যরি, সময় হবে না কালকে। আর আমি আসব কেন? তোমার দরকার হলে তুমি আমাদের বাসায় এসো।
বিদ্যুতের মত আমার মাথায় যেন হাজার ভোল্টের বাজ পড়ল।
-এ কি ধরনের কথা বলছ তুমি জ্বান?
-জ্বান? (আমার কন্ঠকে ব্যাঙ্গোক্তি করল ও) আমি তোমার জ্বান আবার কবে থেকে হলাম!
নিখাদ বিস্ময় ঝড়ে পড়ল ওর কন্ঠে।
-দেখো মৌসুমি, আমার সাথে ফাজলামি করো না প্লিজ। কাল তোমার সাথে গুরুত্ব পূর্ণ কথা আছে।
-তুমি বোধহয় শুনতে পাওনি। যাক,আবার বলছি স্যরি, কাল আমার সময় হবে না মোটেও। কাল আমাদের বাসায় ফয়সাল আসছে।
অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল কৃষ্ণকেশী।
-তুমি কি আমার প্রতি রাগ করেছ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি কৃষ্ণকেশীকে।
-রাগ? তোমার সাথে? তুমি আমার এমন কি হও যে তোমার সাথে আমি রাগ করব।
“আমাকে তুমি ভালবাস” বলতে যেয়েও বললাম না। বললাম
-এই কি আমাদের কথা ছিল মৌসুমি?
-দেখ আরাফাত, কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত ঝড়ে পড়ল ওর। তোমার সাথে সম্পর্কটা ছিল আমাদের দুইজনেরই জীবনের একটা মস্ত ভুল। এ সম্পর্ক আমাদের পরিবার মেনে নিবে না। তার চেয়ে তুমি আমাকে ভুলে যাও। আর তুমি কলেজে উঠলেই দেখবে আমার চেয়ে আরো সুন্দরী মেয়েরা আছে। তোমার আপাতত চলতে কষ্ট হবে না। তাছাড়া তুমি মনে হয় জানো না, আমি ফয়সালকে ভালবাসি। ও জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার আম্মুও ওকে খুব পছন্দ করে। তাহলে শুধু শুধু এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না, টের পেলাম আমি। আমি নির্বাক শ্রোতার মত কৃষ্ণকেশীর কথা শুনতে লাগলাম।
-তুমি বোধহয় ভাবছ তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল তার কি হবে। শুন আরাফাত, তোমার সাথে আমি যদি সম্পর্ক না করতাম, তাহলে এস.এস.সি পরীক্ষায় তুমি পাস করতে পারতে না। সুতরাং আমি যা কিছু করেছি তোমার ভালর জন্যই করেছি।
এরপর অনেক কাঁদলাম আমি।
কখনো একাকী, কখনো ওকে ফোন করে। জোহরা আপা ওকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু ও অনড়।
ওতো সবই বুঝে। আর যে সব বুঝে তাকে বুঝানোর মত সাধ্য কারো নেই। ও পুরোন ঢাকার মেয়ে, আমার চেয়ে অনেক বেশী চঞ্চল আর জেদী।
শুরু হল আমার ভয়ঙ্কর জীবন।
সারাক্ষন মুখে সিগারেট, নিজেকে বিংশ শতাব্দীর দেবদাস মনে হল। এক সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখা হল পাইকপাড়ার আলমগীরের (ছদ্বনাম) সঙ্গে। আমার বাল্যবেলার বন্ধু, কিন্তু ও পড়াশোনা বন্ধ করে নাকি ভয়ঙ্কর কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
আমাকে ডেকে নিল ও। কি করছি, কেমন আছি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল ও। এক পর্যায়ে ওকে কৃষ্ণকেশীর কথা খুলে বললাম। ও আমাকে একটা পুড়িয়া দিল। বলল
-এটা খা, দুনিয়ার শান্তি এর মধ্যে আছে।
আমি কম্পিত হস্তে পুড়িয়াটা খুললাম। ও সেটা দিয়ে গাঁজা বানাল। তারপর আমার হাতে বাড়িয়ে দিল।
বার দুই টান দিয়ে আমার খুকখুক কাশী আসতে লাগল। অসহ্য দুর্গন্ধ!
তবুও আমি জোর করে কষে টান দিলাম স্টিকে। সাথে সাথে মাথা আউলিয়ে গেল আমার।
তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। গাঁজা,মদ,ঝাক্কি,বাশী,ফেনিসিডিল অনেক কিছুই খেলাম।
এক সময় বন্ধু আলমগীর আমাকে কাজে লাগাতে শুরু করল।
যশোর বেনাপোল থেকে আসা অবৈধ অস্ত্র,পেথিডিন,এক প্রকার ট্যাবলেট সব আমি গাবতলী থেকে নিয়ে আসতাম। দুইজন লোক দিয়ে যেত সেই সব। সব নাকি ইন্ডিয়ার মাল।
এক সময় বেশ কিছু টাকা পেলাম হাতে। চিন্তা করলাম কৃষ্ণকেশীর কথা, প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ তাহলে এভাবেই খারাপ হয়!
আমি দ্রূত সিদ্ধান্ত নিলাম। কৃষ্ণকেশীকে আমি তুলে আনব পুরোন ঢাকা থেকে। প্রথমে রেপ করব, তারপর ওকে খুন করব নিজ হাতে।
এলাকার বড় ভাই এবং বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম। বন্ধু আলমগীরকে আগেই বলে রাখলাম যে আমার একটা রিভলবার চাই। ও জিজ্ঞেস করছিল কেন। আমি জবাব দেইনি।
নির্ধারিত দিন আমরা রওনা হলাম সবাই মিলে। পুরোন ঢাকায় পৌছে আমি কৃষ্ণকেশীকে ফোন দিলাম নিচে আসার জন্য। মিনিট পাঁচেক ধাপ্পা মারার পর ও নিচে নেমে এল।
আমার লোকজন তখন সবাই গাড়ির ভিতর।
কৃষ্ণকেশীকে কথা বলতে বলতে গাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। তারপর ও কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরোল ওর গলা দিয়ে। আশেপাশের দু’চারজন মানুষ তখন ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। তাদেরকে বিস্ময়ে রেখেই আমরা গাড়ি নিয়ে সোজা সাভারে চলে এলাম। আমি কৃষ্ণকেশীকে ঠান্ডা গলায় বললাম
-তোমার জন্য তিনটা পথ খোলা আছে মৌসুমি, কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
১. আমাকে বিয়ে করা।
২. তোমাকে ধর্ষন করা।
৩. গুলি করে হত্যা করা।
কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
কৃষ্ণকেশী অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখল।
-তুমিতো এমন ছিলে না আরাফাত। আহহা, তোমার চেহারাটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছ একবার। চল আমাদের এলাকায় গিয়ে আমরা বিয়ে করি। আমিতো শুধু তোমাকেই ভালবাসি।
ঘৃণায় রিরি করে উঠল আমার মন ওর মিষ্টি গলায় ভালবাসার কথা শুনে। আমি আবার পূর্বের কথা পুনরাবৃত্তি করলাম।
ও আগে যেমন অভিমান করলে ফুঁপিয়ে উঠত, ঠিক সেই একই ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল
-তুমি আমাকে যখন একটুও ভালবাস না। তাহলে আমাকে মেরেই ফেল।
আমি চটাশ করে সর্বশক্তি দিয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। এবং তিনটি পথের ভিতর একটি বেছে নেওয়ার কথা বললাম।
থাপ্পরের শব্দে গাড়ির ভিতর সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
এবার ও সরাসরি বলল
-আমি তোমাকে মরে গেলেও বিয়ে করব না।
-গুড, মন্তব্য করলাম আমি। সবাইকে গাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করতে সবাই নেমে গেল। গাড়িটা এখন সাভার পার হয়ে একটা ফাঁকা মাঠের কাছে আছে।
আমি কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করলাম কৃষ্ণকেশীর সাথে। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র এক বছর ছোট, সুতরাং জোর মোটামুটি ভালই আছে ওর শরীরে।
আচমকা আমার দেহের সমস্ত জীদ একসাথে ভর করল আমার মনে। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে বাঁ হাতে কৃষ্ণকেশীর গলা চেপে ধরলাম, একই সাথে সেই হাতের তর্জনী দ্বারা ওর বুকের কিছু কাপড় টেনে নামিয়ে দিলাম। তারপর সুস্থির ভঙ্গিতে ডান হাতে রিভলভারটা মুঠো করে ধরে চোখ বন্ধ করে ওর বুকে নল ঠেকালাম। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই ট্রিগার চেপে দিলাম আমি। ঠাস করে পটকা ফাটার মত তীক্ষ্ণ আওয়াজ হল।
চোখ খুলে কৃষ্ণকেশীর দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় দেখতে পেলাম আমি। গুলি করেই রিভলবার ছেড়ে দিয়ে ওর মাথা ধরে আমার বুকে তুলে নিলাম। আমার হাতে তখন কৃষ্ণকেশীর দেহের ফোটা ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে
-তোকে আমি অনেক বেশী শিক্ষা দিয়ে ফেলেছিরে। তুই কোনদিন আমাকে ক্ষমা করিস না।
বলে ঝড় ঝড় করে আমি হঠাৎ কেঁদে ফেললাম।
ও কথা বলতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ ছাড়া কিছু বের হল না।
আমি ভয়ঙ্কর বিস্ময় নিয়ে দেখলাম গুলিটা ঠিক গলার ভোকাল কর্ডের মাঝামাঝি দিয়ে অতিক্রম করেছে। ছিড়া সেই নালী দিয়ে গলগল করে তাজা লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
অনেক কষ্টে বলে উঠল ও,
-তোমার সাথে আমি যা করেছি তার শাস্তি হিসাবে এটাই উপযুক্ত।
কথাগুলো যেন বহুদূরের কোন গম্বুজ হতে প্রতিধ্বনির মত শুনাল।
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয় গেল আমার জ্বানের কম্পায়মান দেহ। আমার জ্বান মৌসুমি খুন হয়ে গিয়েছে, আমারই গুলিতে।
এতক্ষণ পর, অনেকটা বাংলা ছবির মত আমার বন্ধু আর বড় ভাইরা এল। ঘটনা দেখে সাগর ভাই (ছদ্বনাম) আমাকে বাঁ হাত দিয়ে সজোরে থাপ্পর দিলেন। আমি তখন ঘোর গলায় রিভলবারটা সাগর ভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। ইশারায় আমাকে গুলি করার জন্য অনুরোধ করলাম। জবাবে আরো দু’চারটা থাপ্পর পড়ল আমার পিঠে। সাগর ভাই সর্বশক্তিতে আমার কপালে একটা ঘুষি দিলেন। তারপরই আমি জ্ঞান হারালাম।
কৃষ্ণকেশীর রক্তকেলী শেষ পর্যন্ত আমিই ঘটালাম।
না, আসলে আমি ঘটাই নি।
ও এখনো বেঁচে আছে, পুরোন ঢাকায় গেলে তার দেখা পাওয়া যাবে। গুলি করার বিষয়টি নিখাদ আমার অবচেতন মনের হিংস্র কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে ও আমার সাথে যে প্রতারণা করেছে, তার শাস্তি ওকে পেতে হবে, নিজের ইজ্জত দিয়ে সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে।
আমিতো ভালই ছিলাম। সাহিত্য রচনা, আর ফুল-পাখি নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আমি কিছুই ভাবতাম না। সেই ভাবনাকে যে নষ্ট করেছে তার ক্ষমা নেই।
তবুও তাকে আমি ভালবাসি। হৃদয় থেকে ভালবাসি।
সে শুধু আমারই কৃষ্ণকেশী, আর কারো নয়।
মোঃ আরাফাত হোসেন
বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ, ২০১০
সপ্তচিত্র
মোঃ আরাফাত হোসেন
শুকনো তেলে ভাজা খনিজ,
কিংবা আগুনের তাপে ভিজে চটচটে বাদ্যযন্ত্র।
হতে পারে হয়তো বা নিকৃষ্ট ডাস্টবিনের কাঁচাকলা।
এগুলো আমি মোটেও খাই না।
কিন্তু ওরা খায়!
ওরা কারা? কেন খায়?
গ্রামে বিশাল অন্দরমহল,
শহরে বিরাট অট্টালিকা।
তবুও ওরা আরও বানাবে।
ছোট্ট ঘরে থেকে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে।
আরও বড় ঘর চাই ওদের।
শক্ত পিচের দুর্বল মনুষ্য পিঁপড়া,
ওরা আর বাঁচতে চায় না।
নিজ কর্ম দ্বারা সৃষ্ট বস্তুর পেষ্টন চায় ওরা।
তাই তো আজ আমি মৃত।
কংক্রিটের মচমচ,
কিংবা অট্টালিকার ক্যাঁচক্যাঁচ।
আমি আর শুনতে পাই না,
তবুও ওরা আমাকে শুনাতে চায়।
বাতাসে রক্তের গন্ধ; আকাশ নিশ্চল নির্বাক।
তারই মধ্যে আমি চললাম; এইতো পথের শুরু মাত্র!
শুকনো তেলে ভাজা খনিজ,
কিংবা আগুনের তাপে ভিজে চটচটে বাদ্যযন্ত্র।
হতে পারে হয়তো বা নিকৃষ্ট ডাস্টবিনের কাঁচাকলা।
এগুলো আমি মোটেও খাই না।
কিন্তু ওরা খায়!
ওরা কারা? কেন খায়?
গ্রামে বিশাল অন্দরমহল,
শহরে বিরাট অট্টালিকা।
তবুও ওরা আরও বানাবে।
ছোট্ট ঘরে থেকে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে।
আরও বড় ঘর চাই ওদের।
শক্ত পিচের দুর্বল মনুষ্য পিঁপড়া,
ওরা আর বাঁচতে চায় না।
নিজ কর্ম দ্বারা সৃষ্ট বস্তুর পেষ্টন চায় ওরা।
তাই তো আজ আমি মৃত।
কংক্রিটের মচমচ,
কিংবা অট্টালিকার ক্যাঁচক্যাঁচ।
আমি আর শুনতে পাই না,
তবুও ওরা আমাকে শুনাতে চায়।
বাতাসে রক্তের গন্ধ; আকাশ নিশ্চল নির্বাক।
তারই মধ্যে আমি চললাম; এইতো পথের শুরু মাত্র!
ওরা রাজাকার
মোঃ আরাফাত হোসেন
আবার শুরু যুদ্ধের প্রহসন,
শুভ্র-নীল আকাশে আদিম ধাতব অস্ত্রের আর্তনাদ,
গৌর-সবুজের এ বনে সেই অস্ত্রের তীব্র গন্ধ!
শুধু নেই কোন মৃত মানুষ!
চারিদিকে নিপীড়ণ আর নির্যাতনে আক্রান্ত
জীবিত মানুষের কল্পিত মৃত আত্না!
সেই আত্না কেউ চোখে দেখে না।
অদৃশ্য সেই আত্নার শম্ভুসম
অত্যাচারের কাহিণী কেউ জানে না।
দিব্যদৃষ্টির বেড়াজালে মৃত আত্না দৃশ্যময়,
কিন্তু কোথায় সেই হননকারী?
যে মনুষ্যের স্বত্তাকে পরিস্রুত চালনী সমেত
ছেঁকে আলাদা করেছে!
ওই দূর অতল হতে কার
হিংস্র-উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়?
না,অত দূরে নয়,
এইতো ওরা নিকটে।
আর সংখ্যায় তো একজন নয়,
ওরা অগণিত।
মনুষ্য চম্র দ্বারা আবৃত পশুসম দানব ওরা!
ওরা এই আলো-আঁধারের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে গেছে।
বিষ রক্তচক্ষুর দাবানল জ্বেলে ধ্বংসস্তুপ মৃতপ্রায়
পৃথিবীকে বারবার চিতার অঙ্গারে পিষছে ওরা!
ওরা রাজাকার!
কিংবা তারচেয়েও বেশী।
মনুষকুলের প্রতিকৃতির মতই একত্রিত ওরা।
ওদের নির্মমভাবে চেপে ধর!
প্রজ্জলিত লেলিহান অগ্নিশিখায়,
কিংবা উত্তরের অসহণীয় হীমজলে নয়,
ওদের ছুড়ে ফেলে দে ময়লা গুয়ের জঞ্জালে!
যেখানে প্রতিনিয়ত করুণ
আর অসহায় ধ্বনি ফুটাবে ওরা!
জীবন নয়,কুক্ষিগত জটলাও নয়,
একটু সম্মান ভিক্ষা চাইবে ওরা!
এইতো প্রকৃত রাজাকারের শাস্তি।
আবার শুরু যুদ্ধের প্রহসন,
শুভ্র-নীল আকাশে আদিম ধাতব অস্ত্রের আর্তনাদ,
গৌর-সবুজের এ বনে সেই অস্ত্রের তীব্র গন্ধ!
শুধু নেই কোন মৃত মানুষ!
চারিদিকে নিপীড়ণ আর নির্যাতনে আক্রান্ত
জীবিত মানুষের কল্পিত মৃত আত্না!
সেই আত্না কেউ চোখে দেখে না।
অদৃশ্য সেই আত্নার শম্ভুসম
অত্যাচারের কাহিণী কেউ জানে না।
দিব্যদৃষ্টির বেড়াজালে মৃত আত্না দৃশ্যময়,
কিন্তু কোথায় সেই হননকারী?
যে মনুষ্যের স্বত্তাকে পরিস্রুত চালনী সমেত
ছেঁকে আলাদা করেছে!
ওই দূর অতল হতে কার
হিংস্র-উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়?
না,অত দূরে নয়,
এইতো ওরা নিকটে।
আর সংখ্যায় তো একজন নয়,
ওরা অগণিত।
মনুষ্য চম্র দ্বারা আবৃত পশুসম দানব ওরা!
ওরা এই আলো-আঁধারের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে গেছে।
বিষ রক্তচক্ষুর দাবানল জ্বেলে ধ্বংসস্তুপ মৃতপ্রায়
পৃথিবীকে বারবার চিতার অঙ্গারে পিষছে ওরা!
ওরা রাজাকার!
কিংবা তারচেয়েও বেশী।
মনুষকুলের প্রতিকৃতির মতই একত্রিত ওরা।
ওদের নির্মমভাবে চেপে ধর!
প্রজ্জলিত লেলিহান অগ্নিশিখায়,
কিংবা উত্তরের অসহণীয় হীমজলে নয়,
ওদের ছুড়ে ফেলে দে ময়লা গুয়ের জঞ্জালে!
যেখানে প্রতিনিয়ত করুণ
আর অসহায় ধ্বনি ফুটাবে ওরা!
জীবন নয়,কুক্ষিগত জটলাও নয়,
একটু সম্মান ভিক্ষা চাইবে ওরা!
এইতো প্রকৃত রাজাকারের শাস্তি।
লোভ
মোঃআরাফাত হোসেন
বলো হে বীর,হে সাহসী,হে সরওয়ার,
যবে ছিনু আমি শ্ত্রুপক্ষ
আজ বন্ধু তার।
কি করে বলো শেষ হল
এই শত্রুতার।
বলো হে হ্রদয়,হে চিত্ত,হে মন প্রাণ,
কবে তোমার শেষ হবে এই
লোভের কলতান।
কবে আবার দেখব আমি এই
দুর্নীতির অবসান।
যবে ছিলে তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী বিস্তর আকার পাহাড়,
ভালবাসা দিয়ে ভেঙ্গে করেছি তা বিশাল চারনাকার,
এখন আবার তুমি আজ হয়েছ দুর্নীবার।
যবে ছিলে তুমি কিশোর বয়সের
ছুটন্ত পেশোয়ার,
ছিল নাকো মনে কোন লোভ
আর কোন উচ্চাশার।
এখন তুমি হয়েছ বড়
বেড়েছে লোভ দুর্বার।
লোভের পথে লাভ আছে
শুনেছে কে কোন কালে,
দৃষ্টি ভ্রুমে স্বপ্ন জোগায়
তোমার চলাচলে।
যদি পার কর আত্নসংযম
ভয় কর পরকালে,
লোভ লালসা সব ঝেড়ে ফেলে দাও
হাসি মুখে জঞ্জালে।
বলো হে বীর,হে সাহসী,হে সরওয়ার,
যবে ছিনু আমি শ্ত্রুপক্ষ
আজ বন্ধু তার।
কি করে বলো শেষ হল
এই শত্রুতার।
বলো হে হ্রদয়,হে চিত্ত,হে মন প্রাণ,
কবে তোমার শেষ হবে এই
লোভের কলতান।
কবে আবার দেখব আমি এই
দুর্নীতির অবসান।
যবে ছিলে তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী বিস্তর আকার পাহাড়,
ভালবাসা দিয়ে ভেঙ্গে করেছি তা বিশাল চারনাকার,
এখন আবার তুমি আজ হয়েছ দুর্নীবার।
যবে ছিলে তুমি কিশোর বয়সের
ছুটন্ত পেশোয়ার,
ছিল নাকো মনে কোন লোভ
আর কোন উচ্চাশার।
এখন তুমি হয়েছ বড়
বেড়েছে লোভ দুর্বার।
লোভের পথে লাভ আছে
শুনেছে কে কোন কালে,
দৃষ্টি ভ্রুমে স্বপ্ন জোগায়
তোমার চলাচলে।
যদি পার কর আত্নসংযম
ভয় কর পরকালে,
লোভ লালসা সব ঝেড়ে ফেলে দাও
হাসি মুখে জঞ্জালে।
হাসপাতাল
মোঃআরাফাত হোসেন
আগ্রার ওই মহল কিবা লুভরের ন্যায় করি,
মহা সম্ভ্রমে উঠিছে সে আজ রাজপথ পাশে গড়ি ।
দশর্ণ নহে, বিদ্যা নহে বিলিছে মহা সেবা,
কত যে প্রাণ মরিল-বাঁচিল খবর রাখিছে কেবা ।
কত যে মনের করুণ আকুতি বাঁচিবার ক্ষণ আশে,
এই বুঝি আজ মরণ ব্যাধি ছাড়িল অবশেষে ।
কেউবা আবার সেবার তরে ফিরিছে সুস্থ দেহে,
অর্থহ্রাসে কেউবা সেবার প্রতীক্ষাতেই রহে ।
কত যে কাহিণী, কত যে যুদ্ধ তার চারিপাশে ঘিরি,
তারি ইতিহাস কালের প্রহাস নিরবে রাখিছে ধরি ।
আহত যোদ্ধা, নিহত বৃদ্ধর করুণ আর্ত সুরে,
থরথর করি সারাটি দেহ সেই সুরে ফিরি মরে ।
এরি মাঝে কত প্রেম-জড়তা উঠিছে সেথায় গড়ি,
কত যে মনের কামনা গিয়াছে শিশিরের ন্যায় ঝরি ।
কত যে স্মৃতি, কত যে সুর রহিছে তারি মাঝে,
সেই স্মৃতি-সুর মনের গহিনে নীরবে কর্ণে বাজে ।
এরি নাম হাসপাতাল,
কত যে ফাগুন বহিছে সেথায় স্বাক্ষী মহাকাল ।
নিশুত রজনী ব্যাস্ত প্রহরী ক্লান্ত দু’চোখ মেলি,
যাইতেছে আজ নব উদ্যামে উজান পথে চলি ।
দেখিতে দেখিতে সময় চলিছে ফাগুনও গেছে ছাড়ি,
তবু বুঝি তার ফুরিলনা কাজ চলিছে সেবার গাড়ি ।
আগ্রার ওই মহল কিবা লুভরের ন্যায় করি,
মহা সম্ভ্রমে উঠিছে সে আজ রাজপথ পাশে গড়ি ।
দশর্ণ নহে, বিদ্যা নহে বিলিছে মহা সেবা,
কত যে প্রাণ মরিল-বাঁচিল খবর রাখিছে কেবা ।
কত যে মনের করুণ আকুতি বাঁচিবার ক্ষণ আশে,
এই বুঝি আজ মরণ ব্যাধি ছাড়িল অবশেষে ।
কেউবা আবার সেবার তরে ফিরিছে সুস্থ দেহে,
অর্থহ্রাসে কেউবা সেবার প্রতীক্ষাতেই রহে ।
কত যে কাহিণী, কত যে যুদ্ধ তার চারিপাশে ঘিরি,
তারি ইতিহাস কালের প্রহাস নিরবে রাখিছে ধরি ।
আহত যোদ্ধা, নিহত বৃদ্ধর করুণ আর্ত সুরে,
থরথর করি সারাটি দেহ সেই সুরে ফিরি মরে ।
এরি মাঝে কত প্রেম-জড়তা উঠিছে সেথায় গড়ি,
কত যে মনের কামনা গিয়াছে শিশিরের ন্যায় ঝরি ।
কত যে স্মৃতি, কত যে সুর রহিছে তারি মাঝে,
সেই স্মৃতি-সুর মনের গহিনে নীরবে কর্ণে বাজে ।
এরি নাম হাসপাতাল,
কত যে ফাগুন বহিছে সেথায় স্বাক্ষী মহাকাল ।
নিশুত রজনী ব্যাস্ত প্রহরী ক্লান্ত দু’চোখ মেলি,
যাইতেছে আজ নব উদ্যামে উজান পথে চলি ।
দেখিতে দেখিতে সময় চলিছে ফাগুনও গেছে ছাড়ি,
তবু বুঝি তার ফুরিলনা কাজ চলিছে সেবার গাড়ি ।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)