Menu Bar

মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০১০

কৃষ্ণকেশীর রক্তকেলী

জানিনা কি অপরাধ করেছিলাম আমি যে নিজের জীবনের কাহিণী আজ আমাকে গল্প হিসেবে লিখতে হচ্ছে। তবুও লিখছি,শুনুন তবে।
যৌবন তখন আমার সবে শুরু হয়েছে। মনের ভিতর আশ্চর্য এক নিঃস্বঙ্গতা। চার মাস পর এস.এস.সি পরীক্ষা,তবুও কোরবানীর ঈদে বাড়ীতে গেলাম। দীর্ঘ তিন বছর পর দেখতে পেলাম সোনালি রোদ্দুরের আলোয় স্নিগ্ধ রূপের সেই মায়াবতীকে, আমার আপন চাচাতো বোন।
ওরাও পুরোন ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে। অতিরিক্ত চঞ্চল, বয়সে আমার চেয়ে এক বছর ছোট। তবে কৃষ্ণকেশ এবং সুডৌল উন্নত রূপের পাশাপাশি কুচকুচে কাল মায়াবী হরিণীর মত চোখের কল্যাণে পৃথিবীর সমস্ত কৌশল ওর নখদর্পণে।
সম্পর্কটা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আমি যদিও চাচা-চাচীর কথা ভেবে একটু দমে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওর সাহসিকতার কাছে সেই সব নস্যাৎ হয়ে গেল।
আর সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের মত সুযোগ পেলে বাসা থেকে বের হয়ে ডেটে যাওয়া হয়নি আমাদের। হয়েছে বাসায় যেয়ে দেখা করা শুধু। যখনি চাচা-চাচী বাসায় থাকতেন না তখনি ও আমাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলত। ক্রমে আমার এস.এস.সি পরীক্ষার পড়াশোনা শিকেয় উঠল। সারাক্ষণ কৃষ্ণকেশীর কথা,কিভাবে অল্প বয়সে পালিয়ে বিয়ে করব সেই সব আবেগময় স্বপ্ন।
এর মাঝে আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। আব্বা-আম্মা যেতে দিতে চাইলেন না।
আমি জোর করে গেলাম,কারণ কৃষ্ণকেশী আসছে বিয়েতে।
রাতের লঞ্চে উঠেও মূহুর্তের জন্য দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না তার কথা ভেবে।
ভোরবেলা ফুপুর বাসায় যেয়ে দেখি সবাই যখন ঘুমাচ্ছে,সেই সময় ও আমার জন্য চুপিসারে বসে আছে ফুপুদের পাশের ঘরে। ঘটনা তখন আমার আর সব ফুপাতো এবং চাচাতো ভাই-বোনেরা জেনে গেছে। তারা সবাই আমাদের দুইজনকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণকেশী আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকদিন দেখা হয়নি তো আমাদের তাই।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম,আমার চোখটা ভিজা মনে হতে হাত দিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, পানি ঝড়ছে।
প্রথমে আলতো হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। ভারী আশ্চর্য তো! আমার বুকে কিসের যেন এক সীমাহীন প্রশান্তির যন্ত্রনা শুরু হল। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে গেল সারা দেহে।
শিহরণের প্রচন্ড ধাক্কায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল।
একি আশ্চর্য অনুভূতি প্রেমের!
আমি দু’চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণকেশীকে দুইহাতে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় করতে লাগল, এই সুখ হারিয়ে গেলে আমি হয়তো বাঁচব না। আলতো করে কৃষ্ণকেশীর মাথা ধরে উপরে উঠালাম।
প্রথমে মৃদু কাঁপুনি ছাড়া কিছুই হল না। তারপর কম্পিত ভঙ্গিতে আস্তে করে প্রশস্ত ভরাট কপালে একটি চুমু এঁকে দিলাম।
কথা দাও,(আমি ফিসফিস করে বললাম) কোনদিন আমাকে ভুলে যাবে না!
ও অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে আমি সারা পৃথিবীর সরলতা আর পবিত্রতা দেখতে পেলাম।
কৃষ্ণকেশীর দু’ঠোট ফাঁক হয়ে আছে কিছু বলার জন্য। প্রথম কয়েক মূহুর্ত সে কথা বলতে পারল না আবেগের কারণে।
তারপর মাথাটা আমার বুকে এলিয়ে দিল সে। আমার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে আনল
-আমি শুধু তোমার।

এ সময় ঝড়ের বেগে আমার চাচা ঘরে ঢুকলেন। আমরা তখনও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছি।
তিনি একটা কথাও বললেন না। সাড়াশীর মত ডানহাত দিয়ে থাবা দিয়ে নিজের মেয়েকে ছিনিয়ে নিলেন আমার কাছ হতে। আমি কোন কিছু অনুভব করতে পারলাম না ঘটনার আকস্মিকতায়।
সেই রাতেই চাচা-চাচী প্রাইভেট কার ভাড়া করে চলে গেলেন। সমস্ত আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে যারা বাকী ছিল তারাও আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেল। সবাই আমাকে ভীষন অপদার্থ মনে করতে লাগল। আমার কারণে চাচা-চাচী বিয়ে বাড়িতে কোন রকম সামাজিক কর্ম সমাধা না করেই চলে গেলেন।

বিয়ে শেষে আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। ওইদিন আমার ফুপাতো ভাই আমাকে ফোন করে জানাল যে কৃষ্ণকেশী আমার জন্য কেঁদে কেঁদে নিজেকে নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছে।
আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমিও আব্বা-আম্মার দিক হতে এ নিয়ে প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছি। একমাস বাকী পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার। এর মধ্যে একদিন সুযোগ এসে গেল।
কৃষ্ণকেশী আমাকে জানাল যে তাদের বাসায় কেউ নেই,আমি যেন এক্ষুনি চলে আসি।
বিশ মিনিটের ভিতর আমি তৈরি হয়ে নিলাম। আমাদের বাসা মিরপুর-১ থেকে সিএনজিতে উঠে ঘন্টা দেড়েকের ভিতর আমি তার বাসায় পৌছে গেলাম। ঘর তখন পুরো খালি,শুধু আমার ফুপাতো বোন জোহরা আপা ছিলেন তাদের বাসায়। আপা জানালেন সে একটু মার্কেটে গেছে।
খানিকবাদে দরজায় বেল পড়তে আমি দৌড়ে গিয়ে হুড়কো খুলে দিলাম।
কৃষ্ণকেশী দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় ক্লান্ত এবং মৃদু ঘামের ছাপ। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য স্নান সমাপ্ত মেয়েটি এসে হাজির হয়েছে।
নজরেতে চাহি মোর পলক নাহি পড়ে,
লোকে তারে কাল বলি সদা ব্যাঙ্গ করে।
নিজ দেহ,নিজ বস্ত্র জগৎ জোড়া ভাল,
মোর প্রিয়া মোর কাছে প্রদীপসম আলো।

আমি নিজের রচিত একটি কবিতা মনে মনে আউড়িয়ে গেলাম। তারপর কৃষ্ণকেশীর চোখে চোখ রাখলাম। সেখানে মৃদু রাঙ্গা আভা আর খুশীর ঝিলিক দেখতে পেলাম। ধীর স্থির ভঙ্গিতে এক হাত দিয়ে টেনে ওকে আমার শরীরের কাছে টেনে আনলাম। ও পরম নির্ভরতায় আমার বুকে মাথা গুজে চোখ বন্ধ করল।
আমরা ড্রইং রূমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ওর জন্য বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে আরচিজ (ARCHIZ) থেকে একটা নেকলেস আর পায়ের নূপুর কিনেছিলাম। নিজ হাতে ওকে পড়িয়ে দিলাম আমি। ও ভীষন খুশী হল।
প্রায় চার ঘন্টা পার হয়ে গেল কি করে, তা আমি বুঝতেই পারলাম না।
বিদায় নিতে যেয়ে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল।
শেষ মূহুর্তে যাওয়ার সময় ও কান্না জড়িত কন্ঠে আমাকে বলল- আরাফাত, তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর প্লিজ। তা না হলে আব্বা-আম্মা আমাকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে।
বলে কাঁদতে কাঁদতে ও আমার পায়ে পড়ে গেল।
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বুকের পাথরটাকে জাকিয়ে বসার সুযোগ দিলাম। ভাঙ্গা গলায় বললাম- আমার এস.এস.সি পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপরই আমরা বিয়ে করব,তুমি কোন চিন্তা অথবা কান্নাকাটি করো না।
শেষ কথাটি বলতে আমার বুক ফেটে কান্না আর হাহাকার বেড়িয়ে এল- তুমি একদম কাঁদবে না। তাহলে যে আমি নিজেকে টিকিয়ে রাখার কোন সান্তনাই পাব না।
বলে আর দাঁড়ালাম না। সোজা হেটে রাস্তার মাথায় চলে আসলাম। বাঁক নেওয়ার সময় শেষবার ক্ষনিকের জন্য পেছন দিকে তাকালাম। সেখানে কৃষ্ণকেশীর মাথায় জোহরা আপা আদর মাখা সোহাগ বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণকেশী নির্বাক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ভরা শ্রাবণের বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে দু’চোখে।
আমার হঠাৎ একটা কথা ভেবে ভাল লাগল নিজের কাছে। আর কেউ না হোক, আমার আত্নীয় ভাই-বোনরা তো আমাদের সাথে আছে!

দেড় মাস পরঃ

কাল আমার কম্পিউটার পরীক্ষা। তারপরই এস.এস.সি-এর ঝামেলা শেষ। কতদিন কথা হয়না কৃষ্ণকেশীর সাথে হিসাব করলাম আমি। দীর্ঘ একমাস পঁচিশ দিন।
পরদিন পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র তাকে কল করলাম আমি।
-বিজি।
আবার কল করলাম পাঁচ মিনিট পর।
-বিজি।
ঘটনা কি? আমি একটানা সতের বার কল করার পর তারপর ওকে পেলাম। কল রিসিভ করল ও।
-হ্যালো, কেমন আছ আরাফাত?
আগের মতই রূপকথা জগতের সুরেলা কন্ঠ। কিন্তু সেই কন্ঠে ভালবাসার ছিটেফোটা নেই। আমি বললাম
-আগামীকাল বিকেলে রমনা পার্কে এসো।
-স্যরি, সময় হবে না কালকে। আর আমি আসব কেন? তোমার দরকার হলে তুমি আমাদের বাসায় এসো।
বিদ্যুতের মত আমার মাথায় যেন হাজার ভোল্টের বাজ পড়ল।
-এ কি ধরনের কথা বলছ তুমি জ্বান?
-জ্বান? (আমার কন্ঠকে ব্যাঙ্গোক্তি করল ও) আমি তোমার জ্বান আবার কবে থেকে হলাম!
নিখাদ বিস্ময় ঝড়ে পড়ল ওর কন্ঠে।
-দেখো মৌসুমি, আমার সাথে ফাজলামি করো না প্লিজ। কাল তোমার সাথে গুরুত্ব পূর্ণ কথা আছে।
-তুমি বোধহয় শুনতে পাওনি। যাক,আবার বলছি স্যরি, কাল আমার সময় হবে না মোটেও। কাল আমাদের বাসায় ফয়সাল আসছে।
অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল কৃষ্ণকেশী।
-তুমি কি আমার প্রতি রাগ করেছ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি কৃষ্ণকেশীকে।
-রাগ? তোমার সাথে? তুমি আমার এমন কি হও যে তোমার সাথে আমি রাগ করব।
“আমাকে তুমি ভালবাস” বলতে যেয়েও বললাম না। বললাম
-এই কি আমাদের কথা ছিল মৌসুমি?
-দেখ আরাফাত, কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত ঝড়ে পড়ল ওর। তোমার সাথে সম্পর্কটা ছিল আমাদের দুইজনেরই জীবনের একটা মস্ত ভুল। এ সম্পর্ক আমাদের পরিবার মেনে নিবে না। তার চেয়ে তুমি আমাকে ভুলে যাও। আর তুমি কলেজে উঠলেই দেখবে আমার চেয়ে আরো সুন্দরী মেয়েরা আছে। তোমার আপাতত চলতে কষ্ট হবে না। তাছাড়া তুমি মনে হয় জানো না, আমি ফয়সালকে ভালবাসি। ও জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার আম্মুও ওকে খুব পছন্দ করে। তাহলে শুধু শুধু এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না, টের পেলাম আমি। আমি নির্বাক শ্রোতার মত কৃষ্ণকেশীর কথা শুনতে লাগলাম।
-তুমি বোধহয় ভাবছ তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল তার কি হবে। শুন আরাফাত, তোমার সাথে আমি যদি সম্পর্ক না করতাম, তাহলে এস.এস.সি পরীক্ষায় তুমি পাস করতে পারতে না। সুতরাং আমি যা কিছু করেছি তোমার ভালর জন্যই করেছি।
এরপর অনেক কাঁদলাম আমি।
কখনো একাকী, কখনো ওকে ফোন করে। জোহরা আপা ওকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু ও অনড়।
ওতো সবই বুঝে। আর যে সব বুঝে তাকে বুঝানোর মত সাধ্য কারো নেই। ও পুরোন ঢাকার মেয়ে, আমার চেয়ে অনেক বেশী চঞ্চল আর জেদী।
শুরু হল আমার ভয়ঙ্কর জীবন।
সারাক্ষন মুখে সিগারেট, নিজেকে বিংশ শতাব্দীর দেবদাস মনে হল। এক সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখা হল পাইকপাড়ার আলমগীরের (ছদ্বনাম) সঙ্গে। আমার বাল্যবেলার বন্ধু, কিন্তু ও পড়াশোনা বন্ধ করে নাকি ভয়ঙ্কর কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
আমাকে ডেকে নিল ও। কি করছি, কেমন আছি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল ও। এক পর্যায়ে ওকে কৃষ্ণকেশীর কথা খুলে বললাম। ও আমাকে একটা পুড়িয়া দিল। বলল
-এটা খা, দুনিয়ার শান্তি এর মধ্যে আছে।
আমি কম্পিত হস্তে পুড়িয়াটা খুললাম। ও সেটা দিয়ে গাঁজা বানাল। তারপর আমার হাতে বাড়িয়ে দিল।
বার দুই টান দিয়ে আমার খুকখুক কাশী আসতে লাগল। অসহ্য দুর্গন্ধ!
তবুও আমি জোর করে কষে টান দিলাম স্টিকে। সাথে সাথে মাথা আউলিয়ে গেল আমার।
তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। গাঁজা,মদ,ঝাক্কি,বাশী,ফেনিসিডিল অনেক কিছুই খেলাম।
এক সময় বন্ধু আলমগীর আমাকে কাজে লাগাতে শুরু করল।
যশোর বেনাপোল থেকে আসা অবৈধ অস্ত্র,পেথিডিন,এক প্রকার ট্যাবলেট সব আমি গাবতলী থেকে নিয়ে আসতাম। দুইজন লোক দিয়ে যেত সেই সব। সব নাকি ইন্ডিয়ার মাল।
এক সময় বেশ কিছু টাকা পেলাম হাতে। চিন্তা করলাম কৃষ্ণকেশীর কথা, প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ তাহলে এভাবেই খারাপ হয়!
আমি দ্রূত সিদ্ধান্ত নিলাম। কৃষ্ণকেশীকে আমি তুলে আনব পুরোন ঢাকা থেকে। প্রথমে রেপ করব, তারপর ওকে খুন করব নিজ হাতে।
এলাকার বড় ভাই এবং বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম। বন্ধু আলমগীরকে আগেই বলে রাখলাম যে আমার একটা রিভলবার চাই। ও জিজ্ঞেস করছিল কেন। আমি জবাব দেইনি।
নির্ধারিত দিন আমরা রওনা হলাম সবাই মিলে। পুরোন ঢাকায় পৌছে আমি কৃষ্ণকেশীকে ফোন দিলাম নিচে আসার জন্য। মিনিট পাঁচেক ধাপ্পা মারার পর ও নিচে নেমে এল।
আমার লোকজন তখন সবাই গাড়ির ভিতর।
কৃষ্ণকেশীকে কথা বলতে বলতে গাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। তারপর ও কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরোল ওর গলা দিয়ে। আশেপাশের দু’চারজন মানুষ তখন ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। তাদেরকে বিস্ময়ে রেখেই আমরা গাড়ি নিয়ে সোজা সাভারে চলে এলাম। আমি কৃষ্ণকেশীকে ঠান্ডা গলায় বললাম
-তোমার জন্য তিনটা পথ খোলা আছে মৌসুমি, কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
১. আমাকে বিয়ে করা।
২. তোমাকে ধর্ষন করা।
৩. গুলি করে হত্যা করা।
কোনটা বেছে নিতে চাও তুমি সেটা তোমার ব্যপার।
কৃষ্ণকেশী অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখল।
-তুমিতো এমন ছিলে না আরাফাত। আহহা, তোমার চেহারাটার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছ একবার। চল আমাদের এলাকায় গিয়ে আমরা বিয়ে করি। আমিতো শুধু তোমাকেই ভালবাসি।
ঘৃণায় রিরি করে উঠল আমার মন ওর মিষ্টি গলায় ভালবাসার কথা শুনে। আমি আবার পূর্বের কথা পুনরাবৃত্তি করলাম।
ও আগে যেমন অভিমান করলে ফুঁপিয়ে উঠত, ঠিক সেই একই ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল
-তুমি আমাকে যখন একটুও ভালবাস না। তাহলে আমাকে মেরেই ফেল।
আমি চটাশ করে সর্বশক্তি দিয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। এবং তিনটি পথের ভিতর একটি বেছে নেওয়ার কথা বললাম।
থাপ্পরের শব্দে গাড়ির ভিতর সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
এবার ও সরাসরি বলল
-আমি তোমাকে মরে গেলেও বিয়ে করব না।
-গুড, মন্তব্য করলাম আমি। সবাইকে গাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করতে সবাই নেমে গেল। গাড়িটা এখন সাভার পার হয়ে একটা ফাঁকা মাঠের কাছে আছে।
আমি কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করলাম কৃষ্ণকেশীর সাথে। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র এক বছর ছোট, সুতরাং জোর মোটামুটি ভালই আছে ওর শরীরে।
আচমকা আমার দেহের সমস্ত জীদ একসাথে ভর করল আমার মনে। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে বাঁ হাতে কৃষ্ণকেশীর গলা চেপে ধরলাম, একই সাথে সেই হাতের তর্জনী দ্বারা ওর বুকের কিছু কাপড় টেনে নামিয়ে দিলাম। তারপর সুস্থির ভঙ্গিতে ডান হাতে রিভলভারটা মুঠো করে ধরে চোখ বন্ধ করে ওর বুকে নল ঠেকালাম। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই ট্রিগার চেপে দিলাম আমি। ঠাস করে পটকা ফাটার মত তীক্ষ্ণ আওয়াজ হল।
চোখ খুলে কৃষ্ণকেশীর দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় দেখতে পেলাম আমি। গুলি করেই রিভলবার ছেড়ে দিয়ে ওর মাথা ধরে আমার বুকে তুলে নিলাম। আমার হাতে তখন কৃষ্ণকেশীর দেহের ফোটা ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে
-তোকে আমি অনেক বেশী শিক্ষা দিয়ে ফেলেছিরে। তুই কোনদিন আমাকে ক্ষমা করিস না।
বলে ঝড় ঝড় করে আমি হঠাৎ কেঁদে ফেললাম।
ও কথা বলতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ ছাড়া কিছু বের হল না।
আমি ভয়ঙ্কর বিস্ময় নিয়ে দেখলাম গুলিটা ঠিক গলার ভোকাল কর্ডের মাঝামাঝি দিয়ে অতিক্রম করেছে। ছিড়া সেই নালী দিয়ে গলগল করে তাজা লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
অনেক কষ্টে বলে উঠল ও,
-তোমার সাথে আমি যা করেছি তার শাস্তি হিসাবে এটাই উপযুক্ত।
কথাগুলো যেন বহুদূরের কোন গম্বুজ হতে প্রতিধ্বনির মত শুনাল।
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয় গেল আমার জ্বানের কম্পায়মান দেহ। আমার জ্বান মৌসুমি খুন হয়ে গিয়েছে, আমারই গুলিতে।
এতক্ষণ পর, অনেকটা বাংলা ছবির মত আমার বন্ধু আর বড় ভাইরা এল। ঘটনা দেখে সাগর ভাই (ছদ্বনাম) আমাকে বাঁ হাত দিয়ে সজোরে থাপ্পর দিলেন। আমি তখন ঘোর গলায় রিভলবারটা সাগর ভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। ইশারায় আমাকে গুলি করার জন্য অনুরোধ করলাম। জবাবে আরো দু’চারটা থাপ্পর পড়ল আমার পিঠে। সাগর ভাই সর্বশক্তিতে আমার কপালে একটা ঘুষি দিলেন। তারপরই আমি জ্ঞান হারালাম।
কৃষ্ণকেশীর রক্তকেলী শেষ পর্যন্ত আমিই ঘটালাম।
না, আসলে আমি ঘটাই নি।
ও এখনো বেঁচে আছে, পুরোন ঢাকায় গেলে তার দেখা পাওয়া যাবে। গুলি করার বিষয়টি নিখাদ আমার অবচেতন মনের হিংস্র কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে ও আমার সাথে যে প্রতারণা করেছে, তার শাস্তি ওকে পেতে হবে, নিজের ইজ্জত দিয়ে সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে।
আমিতো ভালই ছিলাম। সাহিত্য রচনা, আর ফুল-পাখি নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আমি কিছুই ভাবতাম না। সেই ভাবনাকে যে নষ্ট করেছে তার ক্ষমা নেই।
তবুও তাকে আমি ভালবাসি। হৃদয় থেকে ভালবাসি।
সে শুধু আমারই কৃষ্ণকেশী, আর কারো নয়।


মোঃ আরাফাত হোসেন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন