Menu Bar

শনিবার, ২০ মার্চ, ২০১০

ঢাকা শহরে এক দিনের ভ্রমন

বাসা


“আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই”

মোবাইলে অ্যালার্ম বাজতেই জেগে উঠলাম আমি । সকাল ৭টা বাজে । মুখ ধুয়ে, নাস্তা খেয়ে বাংলাবাজার যেতে হবে । আমার উপন্যাস বের হবে কয়দিন পর । উপন্যাসের নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ ও ‘নাজু’ । কিন্তু সমস্যা হল আমার বাসা মিরপুরে, আর মিরপুর থেকে বাংলাবাজার যাওয়া মানে ঢাকা মেট্রপলিটন শহরের প্রায় পুরোটাই ঘুরে যাওয়া । আমি ছাত্র মানুষ, প্রথমদিকে উপন্যাস বের করার মত টাকা যোগাতে পারিনি ।

তাই বলে থেমে থাকিনি কিন্তু, বহুজন ও বহু প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করেছি ।

সত্যি কথা বলতে কি, দেশের দৈনিক প্রথম আলো থেকে শুরু করে যত রকম ছোট-বড় পত্রিকা, ম্যাগাজিন রয়েছে তাদের অধিকাংশকেই বিরক্ত করেছি বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ই-মেইল পাঠিয়ে । এমন কি ব্যাঙ্ক,প্রাইভেট কোম্পানী, চ্যাট রুম, টিভি চ্যানেল এবং রেডিও চ্যানেলও বাদ রাখিনি ।

আমি সবার কাছে একটাই মেইল পাঠাতাম, তা হল এরকম-

Dear Sir,
I am Md.Arafat Hossain, student of Bashir Uddin Adarsha School & College in class-10. I am from Dhaka,Mirpur-1. By the way, I am a writer & I have written some proletereiet novel, such as- “ Meghna Nodir Tire, Narir Kanna, Jiboner Ontorale etc. But I have no capital to publish this novel. Please help me to publish my novel. Your help can be climbed me in the top position in the socity, specially in the literery world. You can contact with me at this number.
Mobile: 01671-856966

মোটামুটি এই ধরনের মেইল পাঠাতাম সকলকে । আর এই মেইল পাঠিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী বিরক্ত করেছি দৈনিক প্রথম আলো-কে । ফলশ্রুতিতে তাদের অফিস থেকে দুই/তিনবার বাসায় ফোন করে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে ।

যাই হোক, এজন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট হতে ক্ষমা প্রার্থী ।

তো, উপন্যাস বের করার জন্য আমি প্রকাশক সাহেবকে পাক্কা পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি । আর সবচেয়ে আজব বেপার হল, আমি গিয়েছিলাম আমার এক পরিচিত লেখক সাগর আঙ্কেলের সাথে । পরে জানতে পারলাম উনি আমার দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক হাজার টাকা দালালী খেয়েছেন । একথা জেনেছি আমি প্রকাশক সাহেবের কাছ থেকে ।
মোট কথা, জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম যে উপন্যাস ছাপাতে গেলেও দালালী খাওয়া হয় ।

আসল কথায় আসি এবার । নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম বাংলাবাজার যাওয়ার জন্য ।
মাকে বললাম- আম্মু, পঞ্চাশটা টাকা দাওতো, বাংলাবাজার যাব ।

-বাংলাবাজার যেয়ে যেয়ে তুই এ পযর্ন্ত কত টাকা খরচ করেছিস হিসাব আছে ? উপন্যাস ছাপিয়ে করবি টা কি শুনিতো ? সংসারে এত অভাব কি তুই চোখে দেখিস না ? এক কেজি করে চাল আনি, মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে হলুদ-মরিচ আনি । এতো অভাব চোখে দেখেও তুই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেছিস উপন্যাস বের করতে । আরে বাংলাদেশে কি লেখকের অভাব আছে ? তারাও তোর মত আশায় আছে উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হবে । কয়জন সফল হয়েছে দেখাতে পারবি ?

একটানা ক্ষোভের সাথে মা কথাগুলো বলে গেলেন । আমার দুঃখে বুক ফেটে কান্না বের হতে চাইল । আল্লাহ আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বানিয়েছেন । আমদের মত মানুষ সমাজে না পারে টাকার অভাবে নিচু কোন কাজ করতে, না পারে টাকার অভাবে কোন সচ্ছল ব্যবসা করতে । আমাদের এ পাশ কিংবা ও পাশ হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই । কারন মধ্যবিত্ত বলে আমরা একই সাথে সমাজের সকলের সাথে চলাফেরা করি । তাইত মান-সম্মান আর ইজ্জতের মুল্য আমরাই বেশী বুঝি ।

আমি মনে মনে বললাম-দেখো মা, তোমার ছেলে ঠিকই একদিন উপন্যাস লিখে খ্যাতির দোড়গোঁড়ায় পৌছে যাবে । মুখে বললাম- দাও না আম্মু, পঞ্চাশ টাকাই তো । আর মাত্র দুইবার যাব । তারপর উপন্যাস বের হয়ে যাবে, প্লিজ দাও ।

মা কিছু বললেন না, বেরিয়ে গেলেন । আমি জানি, এই পঞ্চাশ টাকা মা পাশের ঘরের সানির মার থেকে ধার করে আনবেন । মা তো মা ই, তাই এত কথার পরও আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিলেন, আর বললেন- রাস্তাঘাটে সাবধানে যাস ।

-ঠিক আছে আম্মু, বলে ঘর হতে বেরিয়ে এলাম আমি । আমরা যে ফ্লাটটায় থাকি সেখানে মোট চারটি রুম । এক রুমে সানীরা, আর এক রুমে গামের্ন্টসে চাকরি করা স্বামী-স্ত্রী, আর একটায় ফ্লাটের মালিকের দোকানের কমর্চারী এবং আর একটায় আমরা থাকি ।

আমি এখন নিজের বুঝ বুঝি । এখনত আর বাবা-মার সাথে এক ঘরে, এক খাটে শোয়া যায় না । তাই আমার মা কর্মচারীদের খাটের পাশে আরেকটা পুরোন খাট ফেলেছে বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে । তবে এজন্য মাসে ছয়শ টাকা দিতে হবে । সকালে বাড়িওয়ালার কর্মচারীরা দোকানে যায়, আসে রাত এগারটায় । এর মাঝে আমি অবসর কাটাই সেই খালি রুমে । রচনা করতে চেষ্টা করি সাহিত্যগাথা, উপন্যাস, ছোট গল্প কিংবা কবিতা ।


মিরপুর-১

বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর-১ এর বাস স্ট্যান্ডে আসতে আমার অনেক সময় লাগল । এর কারণ হল প্রচন্ড জ্যাম ।

না, এই জ্যাম কোন যানবাহনের নয় ।

এ জ্যাম মানুষের জ্যাম ।


ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে হতে শুরু করে রাজপথ পযর্ন্ত সবর্ত্রই তাদের চলাফেরা,
তারা হল গামের্ন্টস কর্মী ।

সকাল বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে, কি এক মহা প্লাবনের ন্যায় আসছে তারা ।

এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে তাদের আসতে দেখা যায় ।

তাদের সম্পর্কে একেক জনের একেক মত ।

বাড়িওয়ালারা বলে- ঢাকা শহরটাকে নরকবাস বানিয়ে ছাড়ল গামের্ন্টস কর্মীরা ।

প্রশাসন বলে- দেশের অধিকাংশ খারাপ কাজ হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মী দ্বারা ।

জননেতারা বলেন- দেশের পোষাক শিল্পের মেরুদন্ড তারা ।

সাধারণ মানুষ বলে- ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় আর এবং জোটবদ্ধ বাহিণী হচ্ছে গামের্ন্টস কর্মীরা ।

কিন্তু আমি বলি অন্য কথা । ওরা কত স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে নিজেদের গ্রাম-পরিবার ফেলে এই হিংস্র কসাইখানার শহর ঢাকায় এসেছে । দু’মুঠো খাবে, কিছু সঞ্চয় করবে পরিবার ও নিজের জন্য । হয়তো কঠিন কিন্তু অদূরে দন্ডায়মান বাস্তব ভবিষ্যতের জন্য ।

এত কিছুর মাঝেও তারা স্বপ্ন দেখে ।

সে স্বপ্ন একাকী নয় । আরেকজনকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন । তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অন্যরকম এক সমাজ । সে সমাজেও আছে প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি ।

কিন্তু তাদের এ সমাজ সভ্য সমাজের স্বীকৃতি হতে বঞ্চিত ও অবহেলিত ।

সকালে যখন গামের্ন্টস শুরু হয় এবং যখন রাতে ছুটি হয়, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু কমর্হীন বাউন্ডুলে ছেলে আর রিক্সাওয়ালারা ।

মেয়েদের দেখলে তারা শিস্ দেয় ।

রিক্সাওয়ালারা মুচকি মুচকি হাসে ।

অনেক সময় তাদের রিক্সার নিয়মিত যাত্রী হয় গামের্ন্টস কর্মীরা ।

রিক্সাওয়ালা তার কল্পিত মাসির্ডিজ গাড়ি নামের রিক্সায় রাজকন্যা নামের গামের্ন্টস কর্মীকে নিয়ে ছুটে চলে ।

যাই হোক, বাসস্ট্যান্ডে পৌছে দেখি সিটিং বাসে টিকিটের স্বল্পতা চলছে, আর লোকাল বাসে চলছে বাঁদড় নাচের প্রতিযোগিতা । কে কত সুন্দরভাবে বাঁদড় নাচ নাচবে, তার উপর ভিত্তি করে বাসে অবস্থান দৃঢ় হবে ।
অগত্যা আমিও বাঁদড় নাচের প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম ।

সকালের মিষ্টি রোদ আর মিষ্টি লাগছে না । বাস ছাড়তেই হঠাৎ ১ নাম্বারের এক মহিলা পাগলী চিৎকার শুরু করল- ওই ড্রাইভার, প্রধানমন্ত্রীরে ফালাইয়া কই যাস ? জলদি আমারে নিয়া যা ।
বলে কাপড়-চোপড় খুলে দিগম্বর হয়ে মহিলা পাগলী বাসের পিছনে দৌড়ানো শুরু করল । ততক্ষণে বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে ।

আহহা বেচারী, আমি আফসোস করি । কোন এক সময় সে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিল । তা না হলে এভাবে কোন মহিলার ব্রেন আউট হওয়ার প্রশ্নই আসেনা ।

কিন্তু তার মার্কা কি ছিল ? পাটগাছ, না জাহাজ মার্কা ?
সন্দেহে পড়ে যাই আমি ।

শ্যামলী

‘ওই হল শ্যামলী, হল শ্যামলী নামেন ।’ চিৎকার করে যাত্রীদের আহ্ববান করে হেল্পার ।

আমি জিগ্যেস করলাম- আচ্ছা ভাই, হল কই ?

হেল্পার আমাকে সামনে দেখিয়ে বলল- ওই যে ।

-কই হলতো নাই ।

-কি জানি, বলে মাথা চুলকাতে লাগল হেল্পার ।

আমি একজনের সিটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । লোকটা শ্যামলীতে নেমে গেল । আমি জ়ায়গা পেয়ে বসে গেলাম । সামনে অসংখ্য যানবাহন । সব শ্যামলীর সিগন্যালে আটকেছে । আমি সিটে বসে উশখুশ করতে লাগলাম । প্রচন্ড রোদের তাপে ঘর্ম স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে সকলের গাত্রদাহ থেকে । তারওপর আবার বাসের ছাঁদ লোহার তৈরি । তাই গরম যেন শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকছে । এছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা দু-চারজন লোকের ঘাম বেয়ে বেয়ে চট করে আমার হাতে বা রানে পড়ছে ।

খুবই অস্তত্বিকর অবস্থা । আমার রুমাল মনে হয় আর ঘাম শুষতে পারছে না । ইতিমধ্যেই ভিজে ঢোল হয়ে গেছে রুমাল ।

এর মধ্যে ভিড় ঠেলে একজন ঠোঙা হাতে ঢুকল ।
-ভাইসব, আসসালামু আলাইকুম । বেশী কথা বলে বাচাল আর ক্যাম্পাসার । আমি কোনটাই না । তাই আপনাদের অনুরোধ করে বলছি যে একবার এই দাঁতের ঔষুধটা ব্যবহার করে দেখুন । দাঁতের পোকা থেকে ময়লাসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিবে । দাম লিখা আছে বিশ টাকা, কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছা সৌজন্যে এর দাম নিচ্ছি মাত্র দশ টাকা, দশ টাকা, দশ টাকা ।
বাংলাদেশের বড় বড় ডেন্টিস্টরা পাঁচশ টাকা, এক হাজার টাকা ভিজিট নিয়েও এই ঔষুধটা দিয়ে থাকেন । তাই আর দেরী না করে একবার এই ঔষুধটা ব্যবহার করুন এবং আপনার অমুল্য দাঁত বাঁচান । কে দিবেন দশ টাকা আমাকে ?
বলে সকলের দিকে তাকাল ঔষধ বিক্রেতা ।
দুই-চারজন কিনলও । এরমধ্যে সবুজ বাতি জ্বলে উঠল । বাস দ্রুত গতিতে এগোন শুরু করল ।

হেল্পার আমাকে জিগ্যেস করল- কই যাইবেন ভাই ?
-গুলিস্তান ।
-১২ টাকা দেন ।
-১২ টাকা দিব কেন ? আমি ছাত্র না ? রাগ করেই বলি আমি ।
-আইচ্ছা ৮ টাকা দেন ।
আমি আট টাকা দিলাম । বাস ততক্ষণে শ্যামলী ছেড়ে যাচ্ছে ।


সংসদ ভবন

সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছে বাস । বাম পাশে সংসদ ভবন । হঠাৎ মৃদু কাশি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল বাসের ইঞ্জিন । বার কয়েক স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল ড্রাইভার । এতেও যখন কাজ হল না, তখন হেল্পার দুজন আর অতি উৎসাহি চারজন যাত্রী বাস ধাক্কা দেয়া শুরু করল ।

কতক্ষন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল ড্রাইভার । যাত্রীদের প্রাপ্য টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বাসের ইঞ্জিন ঠিক করা শুরু করল ।

আমি সংসদ ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম । সংসদ ভবনের বিশাল এরিয়ার ফুটপাথে সারি সারি চটপটি আর চা-কফি সিগারেটের দোকান । আমি চটপটির চলমান টঙের দোকানের নাম পড়া শুরু করলাম ।

রংপুর চটপটি হাউজ, বরিশাল স্পেশাল চটপটি, পাবনা চটপটি বেকারী, চাঁদপুর নাইট-ফাইট উড়া-ধূড়া চটপটি ।

নাম পড়ছিলাম আর এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যেন যাচ্ছিলাম । তাদের নামের বাহারের প্রশংশা করতে হয় ।
এই পেশার মাধ্যমে এক শ্রেণীর নিম্নবিত্ত লোক তাদের সংসার চালাচ্ছে ।
না, তাদের কাস্টমার কোন মন্ত্রী-এমপি নয় । তাদের কাস্টমার হল সংসদে ঘুরতে আসা আমার মত সাধারণ মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভবঘুরে ।
আমি সংসদের গেইটের দিকে এগোতে লাগলাম । আকাশের কোথাও এক ফোটা মেঘের চিহ্ন নেই । দিগন্তের উধ্বর্মুখ হতে যেন নরকের আগুন প্রবাহিত করছে সূর্য্যমামা । রোদের তীব্রতায় পিচঢালা পথও মনে হয় গলে যাচ্ছে ।

এরি মাঝে কুলি আর শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করছে শুধু দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য ।

আমি সংসদ ভবনের সীমানায় প্রবেশ করতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করল- কোথায় যাবেন?
-কোথাও না, এমনিই ঘুরাঘুরি করছি ।
-আজকে ঘোরা যাবে না । সংসদের অধিবেশন শুরু হবে একটু পর ।
-ও। (আমি বোঝার চেষ্টা করি। )

হঠাৎ একটা কথা মনে হতে দাড়োয়ানকে আমি প্রশ্ন করি- আচ্ছা চাচা, আপনি কোন দল করেন? পাটগাছ মার্কা, না জাহাজ মার্কা?
-আমি কোন মার্কাই না । শালা-শালীরা বদমাইশ । (দাড়োয়ানের মুখে ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে )
-কেন কেন? আমি প্রশ্ন করি ।
-আরে যখন যেই দল ক্ষমতায় আইব, হেই দল সংসদের অধিবেশনে এমন সব ওয়াদা করব যেসব ওয়াদা হেগো বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠির মধ্যে কেউ করে নাই ।
-ওইটা কোন সমস্যা না চাচা । মিথ্যা ওয়াদা ছাড়া রাজনীতি হয় না । এই যেমন এই কাজটা আপনি পারেন না দেখেই তো আপনি সংসদের দাড়োয়ান । যদি পারতেন, তাহলে সংসদে আপনার নামে আলাদা সিট থাকত ।
-হ ভাইস্তা, আপনি ঠিকই কইছেন ।
-আচ্ছা চাচা, আমি চলি ।
বলে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । একটু পর একটা গুলিস্তানের বাস পেয়ে গেলাম । তাও কানায় কানায় ঠাসা । ফার্মগেটে গিয়ে শুরু হল জ্যামের প্রতিযোগিতা ।

কোন রাস্তায় বেশী জ্যাম থাকবে তারই প্রতিযোগিতা । রোদের তাপ বাসের ধাতব শরীরে পড়ায় গরম যেন চরম হয়ে দ্বিগুন পরিমানে লাগছে ।
কাওরাণ বাজারের কাছে আসতেই আল্লাহ যেন মুখ তুলে চাইলেন ঢাকাবাসীকে । হঠাৎ আকাশ জুড়ে কাল-সাদা মেঘ । কিছুক্ষণ প্রচন্ড বাতাস হল । এরপরেই নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ।


পল্টন

এখন সকাল ১০টা বাজে । বাস পল্টনে থামতেই নেমে পড়লাম । এখানে একটু কাজ আছে । একটা পার্ট-টাইম জবের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছি ।

বড় একটা বিল্ডিং-এর নিচে দাঁড়ালাম । চারতলায় বড় করে ব্যানারে লেখা ডেসটিনি-২০০০ লিঃ ।

আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল । লিফট দিয়ে সাততলায় উঠলাম । ছয় নম্বর রুমের কাছে এসে ফোন দিতেই আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল একটা ছেলে ।

কাঁচের দরজা । ভিতরে এসি চলছে । পাঁচটা টেবিলে আট-দশজন মানুষ কাজে ব্যস্ত । একটা টেবিলের সামনের একটি মেয়ে আমাকে বসতে বলল ।

-আপনিই আরাফাত?
-জ্বি । (জবাব দিলাম আমি)
-আমাদের এখানে জব করার জন্য আপনাকে ছোট একটা কাজ করতে হবে । পারবেন আপনি?
-ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই পারব ।
-Good, আপনাকে সেলারি দেয়া হবে ৫,০০০ ৳ মাসে । এজন্য আপনাকে ২০ টাকা দিয়ে এই ফরমটা পূরণ করতে হবে আর ৫১৫ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে ।
-তাহলেই কি আমার চাকরী শুরু? (বললাম আমি)
-না, এরপর আপনাকে এই ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে একজন বীমাকারীকে ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করাতে হবে । তাহলে আপনি চাকরীতে পামার্নেন্ট হবেন । এখন ফরমটা কি আমি পূরণ করে দিব?

-No Thanks, রাগ চেপে মুখে হাসি নিয়ে বললাম আমি ।
-আচ্ছা, রেজিস্ট্রেশন ফি আপনার জন্য কমিয়ে দিচ্ছি ।
-যদি পারেন পুরোটাই কমান, তা না হলে আমি আসি ।
-আচ্ছা ঠিক আছে, যান এটা মওকুফ করা হল । কিন্তু বীমাটা আপনাকে করাতে হবে ।
-বীমা করালে কি হবে?
-এখন ৬,০০০ টাকা দিয়ে বীমা করালে আপনি ২ বছর পর ৫০,০০০ টাকা পাবেন ।
-আচ্ছা, আপনাদের কোম্পানীর নাম কি? (আমি সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলাম)
-মুনলাইট ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিঃ ।
-শালীর ঘরের শালী । মনে মনে গাল দিয়ে উঠি আমি । মুখে বললাম- আপনাদের এই বীমা কোম্পানীর নাম জীবনের ফার্স্ট শুনলাম ।
-আসলে এটি নতুন এসেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তো । এর নাম পরে আরও শুনবেন ।
-আচ্ছ ঠিক আছে, পরে যখন আরও শুনব, তখন এসে না হয় চাকরীতে যোগদান করে যাব । (বলেই হনহন করে হেঁটে বের হয়ে এলাম)
--আমাদের চাকরীর পোস্টটা কিন্তু পরশু দিনের মধ্যেই ভরে যাচ্ছে ।
বের হতে হতে শুনলাম মেয়েটার এই শেষ বাক্য ।

গুলিস্তান


আবারও জ্যাম, আবারও সেই প্রচন্ড রোদ । রোদ দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে । গুলিস্তানের কাছাকাছি এসেছি। বাসের ভিতর একের পর এক ছোট-খাট বিক্রেতারা বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ঢুকছে ।

একজন এসে বলল- ওই ঠান্ডা পানি লন । মাত্র ১০ টাকা এক বোতল । লগে একটা চকলেট ফিরি (ফ্রি) ।
চকলেটের জন্য নয়, গলা ভেজানোর জন্য অনেকেই পানি কিনল । আমিও কিনলাম একটা ।
একটু পর এল রুমাল বিক্রেতা- ওই রুমাল লন, ঘাম মুছেন । জোড়া ১০ টাকা, একটা পাঁচ টাকা ।
এরপর এল আইসক্রীম- এই গরমে, ঠান্ডা খান আরামে ।
আমি এদের ব্যবসার টেকনিক দেখে অবাক হয়ে যাই । কি চমৎকারভাবে প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের চাহিদার পরিবতর্ন অনুযায়ী এরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে । আসলে দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতেই তাদের এত ধান্দা-ফিকির করতে হয় । জীবনের নিমর্মতা তাদেরকে করেছে দুরভিসন্ধী ও সুযোগ সন্ধানী ।

গুলিস্তানে এসে পড়েছি, কিন্তু এত জ্যাম । রাস্তা পার হব কি করে । যেদিকে তাকাই শুধু রিক্সা,বাস,প্রাইভেটকারের বাজার বসেছে ।
ট্রাফিক পুলিশ এক হাতে লাঠি আর এক হাতে সুই নিয়ে এগিয়ে এল । এসেই সমানে রিক্সাওয়ালাদের পিঠে গায়ের জোর দিয়ে বাড়ি মারতে লাগল আর সুই দিয়ে টায়ার ফুটা করে দিতে লাগল ।
যেন বিদ্রোহী জনতাকে দমন করছে দাঙা পুলিশ ।
ট্রাফিক পুলিশের ধারণা রিক্সাওয়ালাদের ভাগাতে পারলেই শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের যাতায়াতের একমাত্র বাহণ যে রিক্সা এ কথা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে চায় না

মাজারের অপর পাশ হতে ডাকছে টমটম ঘোড়ার গাড়োয়ান- ওই সদরঘাট আহেন ১০ টাকা, সদরঘাট আহেন ১০ টাকা ।
আমি টমটমে চড়ে বসলাম । মানুষ ভরে যেতেই ঘোড়া চলা শুরু করল । ইংলিশ রোডে আবার প্রচন্ড জ্যাম ।
আমি ঘামে ভিজে প্রায় গোসল করে ফেলেছি ।
হঠাৎ দেখি এক লোক রিক্সাওয়ালার কলার ধরে টানছে। হেঁচকা টান দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে সে রিক্সা হতে নামাল ।

‘ভাড়া বেশী চাইছস কেন? ’ বলেই সজোড়ে চটোপাঘাত করল রিক্সাওয়ালাকে ।
-ভাই ভুল হইছে ভাই, মাফ কইরা দেন । বলে রিক্সাওয়ালা পা ধরে ফেলল লোকটার ।
সামনে কতগুলো স্মার্ট মেয়ে গাড়িতে বসেছিল ।

বিধাতার কি অপুর্ব নিয়ম! রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেকের শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়, আবার অনেকে গাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে এসির বাতাস খায় ।
এই হিংস্র নিষ্টুর শহরে কেউ কাউকে দয়া, ভিক্ষা কিংবা করুণাও করেনা ।
একটু সামনে গিয়ে দেখি আরেক ছেলে রিক্সাওয়ালাকে কলার ধরে নামিয়েই ধাম করে ঘুষি বসিয়ে দিল মুখে। ঘুষির চোটে রিক্সাওয়ালার নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসল।
এবার রিক্সাওয়ালা উঠে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে বেসামাল করে দিল। তারপর সেও কয়েকটা ঘুষি চালিয়ে দিল ছেলেটার নাকে-মুখে।
গরীব আর অসহায় বলে ওরা কি সব সময় অত্যাচার আর মারধোর ভোগ করবে?
না, ওরাও এক সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠে যখন অত্যাচারের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে যায়। এসময় সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠেল। আমাদের টমটম এগিয়ে চলল সদরঘাটের পথে।


বাংলাবাজার

ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১২ টা বাজে। সদরঘাট আর বাংলাবাজার-এর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছি।
সোজা হাটা শুরু করলাম বাংলাবাজারের গলির ভিতর। পাঁচ মিনিট পর পৌছে গেলাম গন্তব্যস্থলে।

সত্যকথা প্রকাশনী

বড় করে লেখা রয়েছে উপরে। আমি ভিতরে ঢুকে প্রকাশক সাহেবকে সালাম দিলাম। উনার নাম রণি আহমেদ।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?
-এইতো ভালই, আমার উপন্যাস বের হবে কবে?
-ভাই আপনিতো বাংলাবাজার থাকেন না, দিনের মধ্যে চৌদ্দ-পনের বার লোডশেডিং হয়। এ কারণে আমাদের প্রকাশণীর কাজ খুব স্লো ভাবে চলছে।
-এখন ভাই আপনিতো জানেনই যে আমি এই উপন্যাস প্রথম আলো পত্রিকায় জমা দিব। সময়তো বেশী নেই। তাড়াতাড়ি করেন না একটু। (আমি প্রকাশক সাহেবকে সমস্যা বোঝাই)
-আইচ্ছা যান, তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করব।
-তো আসি ভাই। বলে বিদায় নিয়ে আসলাম। প্রকাশকের সাহেবের পাশের রুমে কয়েকজন ছেলে বসে রয়েছে। এদের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন লেখক মানুষ।
খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি আর বড় বড় বাবরি চুল। অনেকে কানে রিঙও পড়েছে। কাঁধেও ব্যাগ ঝুলানো রয়েছে।
একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম। সাধারণ পোষাক, স্লিম ফিগার, ক্লিন সেভড আর সাদা চশমা পড়া এক ইনোসেন্ট বয়।
অবশ্য চশমা খুললে নাকি আমাকে শয়তান শয়তান বলে মনে হয়। (আমার বন্ধুদের কথা)
একজন লেখককে প্রশ্ন করলাম।
-ভাই আপনার কি কোন উপন্যাস বের হচ্ছে?
-হ্যাঁ, উপন্যাসের নাম ‘তোমার মরণ হলে আমারও মরণ হবে’ । এই যে দেখুন বই। আমি বইটি হাতে নিলাম, প্রচ্ছদে শাবনূর আর শাকিব খানের ছবি। কিন্তু ছবির নায়ক-নায়িকার নাম লিখা আছে রিয়াজ আর পূণির্মা। আমি বেশ অবাক হলাম, কিন্তু কিছু বললাম না।
-আমার নাম শ্যামল। এই নিন, বইটা আপনাকে উপহার দিলাম।
-অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার একটা বই বের হচ্ছে, নাম- ‘মেঘনা নদীর তীরে’ । বইটি অবশ্যই আপনি নিয়ে যাবেন।
-জ্বি অবশ্যই।
আরেকজন লেখকের সাথে কথা বললাম।
-ভাই, এটিকি আপনার বই?
-জ্বি, এই যে দেখুন।
আমি দেখলাম বইয়ের নাম ‘রঙিলা মাইয়া’ ।
-আপনার আর কোন বই বের হয়েছে? (প্রশ্ন করলাম আমি)
-অনেকগুলো, এই যেমন- ‘সুন্দরী মেয়ে, রসিয়া বন্ধু, পীরিতের আগুন, গরীবের ভালবাসা, রক্ত দিয়ে প্রেমের শুরু ------------
-থাক আর বলতে হবে না, আপনিতো তাহলে একজন খ্যাতিমান লেখক।
আমার কথায় যেন সে লজ্জা পেল। বলল
-না, তা এখনো হতে পারিনি, তবে হয়ে যাব শীঘ্রি।
আর একজন লেখকের দিকে এগোলাম। পরনে জিন্সের প্যান্ট, পেস্ট কালার গেঞ্জি। মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, হাতে ব্রেসলেট আর কানে ব্লুটুথ।
বড় লোকের ছেলে, তাকালেই বোঝা যায়।
-ভাই কি লেখক নাকি?
প্রশ্ন করতেই সে যা শুরু করল আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পাগল নাকিরে বাবা? আমায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে চেয়ারে বসাল সে। তারপর তার কাঁধের ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করল।
তাতে তার লিখা উপন্যাসের নামের তালিকা। কমপক্ষে এক হাজার হবে।
নামের বৈচিত্রও ভিন্নরকম। যেমন-

১. পাগলা মামু,
২. ন্যাঙটা বাবা,
৩. ট্যানাড়ির ভূত,
৪. ছাগলনাইয়া,
৫. ভেড়ামারার মরা ভেড়া,
৬. সেক্রোসাইনিস্টের দেশে ................. ইত্যাদি
নামের তালিকা আমার হাতে দিয়ে ছেলেটা বলল,
-দেখুন, এগুলো সব আমার লিখা উপন্যাস। এগুলোর প্রায় সবগুলো বুকার, পোকার, নোভেল প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন প্রাইজ পাচ্ছিনা কেন বলতে পারেন?
আমি ছেলেটার জন্য আফসোস বোধ করলাম। আসলে হওয়ারই কথা। লাখ-লাখ টাকা খরচ করে এত উপন্যাস বের করছে, অথচ কোন স্বীকৃতি পাচ্ছে না। বললাম
-আপনি বরং এক কাজ করুন, এসব উল্টো-পাল্টা কাহিণী না লিখে গ্রাম বাংলার মানুষ ও সমাজকে নিয়ে কিংবা জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা নিয়ে লিখুন, যেখানে জীবনের ঘটনা সহজে ফুটে উঠবে।
-কি বললেন আপনি? আমি উল্টা-পাল্টা কাহিণী লিখি?
ছেলেটার চোখ-মুখ গরম হয়ে ভয়ানক আকৃতি ধারণ করল। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম
-না, মানে আপনার এই বিখ্যাত অত্যাধুনিক সাহিত্যগাঁথা বেশী বড় তো! এক কাজ করুন, আরও ছোট করে বের করুন, তাহলে লোকে পড়বে। আর আপনিও পুরস্কার জিতবেন।
ছেলেটা মনে হয় এবার কিছুটা শান্ত হল। আমি তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে এলাম। এরকম মাথা গরম লোকের সামনে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।

ধানমন্ডি

দুপুর ২টা বাজছে। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ১০ মিনিট হেঁটে নিউমাকের্ট পৌছলাম। ওভার ব্রিজের পাশের মাকের্টে বেশ কয়েকটা হোটেল। আমি রাস্তার পাশে ছোট একটা হোটেলে ঢুকলাম।
আমি যে হোটেলে বসেছি তার পাশেই একটা আবাসিক হোটেল। উপরে নাম লিখা- ‘হোটেল গ্যালাক্সি প্রাঃ লিঃ ’।
একটু পর পর দেখি একেকজন ঢুকে আর বের হয়। এত তাড়াতাড়ি তারা কি করে বুঝতে পারলাম না। আমি ভাত খেয়ে আবাসিক হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দাঁড়োয়ান বলল,
-কি ভাই, লাগব?
-কত কইরা?
-দেশী মদ ২৫০,ভদকা ৬০০, হুইস্কি ৮০০, আর শ্যাম্পেন ৩০০০ টাকা।
-পুলিশে দেখবো নাতো ভাই?
-আরে কি কন, ধানমন্ডি থানার পুলিশ আমগো পকেটে।
আমি থ হয়ে গেলাম। এই কাজেও প্রশাসনের সহযোগিতা?
আমি চলে যেতে নিচ্ছিলাম, দাঁড়োয়ান প্রশ্ন করল,
-কি ভাই নিবেন না?
-না ভাই। বলে দ্রূত সরে পড়লাম।
ধানমন্ডিতে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে। হঠাৎ তারা এক মোটর সাইকেল আরোহীকে থামাল। আরোহী অল্প বয়সী এক ছেলে।
পুলিশ অফিসার বলল- এই ছেলে, তোমার হুন্ডার কাগজ পত্র আছে?
-জ্বি আছে।
-কই দেখি বের কর।
ছেলেটা লাইসেন্সের ফটোকপি বের করল।
পুলিশ অফিসার বলল- তোমার লাইসেন্সে সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। এই কারণে তুমি ফটোকপি সাথে রাখছ। তোমার বয়সও এখন কম। কাজেই তোমার হুন্ডা চালানো বেআইনী হয়েছে। এখন তুমি কি বল?
-কি বলছেন আঙ্কেল! আমার বয়স ১৯, তাছাড়া আমার লাইসেন্সও ঠিক আছে।
-না না, তোমাকে এখন হুন্ডার সাথে থানায় যেতে হবে। (বলে মুচকী হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল অফিসার)
ছেলেটা সবই বুঝতে পারল। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করল। পুলিশ অফিসার টাকা নিয়েই সাথে সাথে পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বলল,
-আচ্ছা ঠিক আছে, যাও সমস্যা নেই। কিন্তু এরপর থেকে সাবধানে হুন্ডা চালাবে।
ছেলেটা মাথা কাত করে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে মিশে গেল ঢাকা শহরে।
আমি এতক্ষণ অবাক হয়ে দৃশ্যগুলো দেখছিলাম। বাহ! বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ করা জনগণের বন্ধুরা(পুলিশ) যে জনগণের এত কাছে পৌছে যাবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। পৌনে তিনটা বাজে। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
একটা সিএনজি ডাক দিলাম
-এই সিএনজি, কাওরাণবাজার যাবেন?
-যামু।
-চলেন।
-ভাড়া কইলাম ১০০ টাকা।
-কেন কেন? মিটারে যাবেন না?
-না।
-আচ্ছা থাক যাব না। (বললাম আমি)
-মিটারেরতে বিশ টাকা বেশী দিবেন?
-না, দশ টাকা বেশী দিব।
-আইচ্ছা লন।
আমি উঠে বসলাম সিএনজিতে।
জ্যামে আটকা পড়তেই একটি ছোট মেয়ে এগিয়ে এল। হাতে কয়েকটা ফুল। বলল- ভাইজান, একটা ফুল নেন না।
-কত করে ফুল?
-দুইডা দশ টাকা।
-আচ্ছা, দুইটা দাও।
আমি দশ টাকা বের করে দিলাম। ফকিরকে কিছু দান করার চেয়ে এদেরকে দেয়াই ভাল। কারণ ফকিররা বিনা শ্রমে হাত পেতে নিতে চায়। আর ওরা পরিশ্রম করে তার বিনিময়ে দু মুঠো খেতে চায়। ওদের অবশ্য বাড়ি-ঘর নেই। রাতের ঢাকা শহরে বের হলে দেখা যায় ওদের বাসস্থান। রাস্তাই ওদের ঘর, ওদের বিশ্রামখানা, খেলার স্থান। ওদের কখনো সৌভাগ্য হয়নি কোন ছাউনির নিছে একটি রাত ঘুমিয়ে কাটাবার।
সরকার ও নেতা/নেত্রীদের সুদৃষ্টি হতে বঞ্চিত ওরা। তারপরও ওদের কোন আফসুস নেই, নেই কোন অভিযোগ।

কাওরাণবাজার

পম-পম...........পম
ঝক-ঝক, ঝক-ঝক, ঝক-ঝক।
হুইসেল দিয়ে তীব্র গতিতে কমলাপুর স্টেষন থেকে ছুটে আসা বিশাল আন্তঃনগর ট্রেন কাওরাণবাজার রেলগেট অতিক্রম করল। ট্রেন চলে যেতেই রেলগেট উঠিয়ে দিল লাইনম্যান। আবার চলাচল শুরু হল ট্রাক, গাড়ি, রিক্সা, সিএনজি ইত্যাদি।
বামপাশেই তেজগাঁও রেলস্টেষন। একটা লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। পাশের লাইনে বিশাল এক মালগাড়ি।
আমি যাব ডানপাশে, একটা রেললাইন মোড় নিয়েছে চাল-ডালের গুদামের দিকে। ওই গুদামের ডান পাশেই আমার খালুর বাসা। এখন চারটা বাজে। সূ্যর্টা প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঘিঞ্জি আর দূষণযুক্ত ঢাকা শহরে। আমি লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
এই লাইনে ট্রেন আসে মাসে দুই এক বার। চাল-ডাল বা শষ্যাদি নিয়ে যায় অথবা দিয়ে যায় মালগাড়ি। দুই পাশে ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষের সারি সারি বস্তি ঘর।


ঘরগুলো বেড়া, নীল মোটা পলিথিন আর বাশের সাহায্যে বানানো হয়েছে। অধিকাংশ ঘরেই কোন চৌকি বা বিছানা নেই। তবে রেডিও কিংবা টেলিভিশন আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই আছে। শিশুগুলো উলঙ্গভাবে খেলা করছে লাইনের উপরে। অলস, ক্লান্ত আর অবসন্ন বৃদ্ধরা লাইনের উপর বসে উদাসভাবে চেয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ কিংবা বর্ষার প্রবল বষর্ণ এখন আর তাদের স্পর্শ করেনা। কারণ জীবন যুদ্ধে তারা পরাজিত সৈনিক।
বস্তিবাসীরা ঘরের ভিতরই রান্না করে। তাদের পায়খানার ব্যবস্থাত খুবই করুণ। বিভিন্ন ময়লা-আবজর্না তারা লাইনের উপরই ফেলে। অনেকে অভাবের তাড়নায় যে রেললাইনের দুই একটা স্লিপার বা নাট-বল্টু চুরি করেনা তা নয়। বরং এর জন্য তারা বিবেকের কাছে অপরাধী।
এছাড়া আর কিই বা করার আছে তাদের। ক্ষুধার জ্বালা যখন পেটে সৃষ্টি হয়, তখন মনতো আর মানে না।

নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। আমি এসব দৃশ্য দেখছিলাম আর লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। প্রচন্ড উৎকট দুগর্ন্ধ চারপাশে। কিন্তু এর মধ্যে বেঁচে থাকার অভ্যাস তাদের আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি খালুর বাসায় উপস্থিত হলাম।
খালু আমাকে দেখে বেশ খুশী হলেন। আমি সালাম দিয়ে খালুর কুশলাদি জিগ্যেস করলাম।
খালু বললেন- আইজকা এফডিসির শুটিং হইছিল আমগো গুদামের ভিতরে।
-তাই নাকি! আপনিও কি অভিনয় করেছেন?
-হ, (খালু মুচকি হাসি দেন) আমার রোল আছিল নায়ক শাকিব খানরে একটা চাউলের বস্তা উঢাইয়া দিমু।
-ভাল,(আমি মন্তব্য করি)। আচ্ছা খালু, এফডিসি কোন জায়গায়?
-এহান থিকা রেললাইন দিয়া সোজা হাইটা গেলে প্রথমে যে রোড পড়ব, হেই রোডের বাম সাইডে গেলেই এফডিসি পাবি।

কিছুক্ষণ পর খালু আমাকে ঘরে বসিয়ে বাইরে গেলেন। আমি একা একা উশখুশ করছিলাম, হঠাৎ দরজার বাইরে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল।

-কাকা কোথায়?
-কাকা, মানে আমার ইউনুস খালু?
-জ্বি।
-উনি একটু বাইরে আছেন। কোন সমস্যা? (আমি জানতে চাইলাম)
-না না, এমনিই। আচ্ছা, আপনি উনার কি হন?
-আমি উনার কি হই তাতো আমি বলতে পারব না, তবে উনি আমার খালু হন।
-ও, তার মানে আপনি উনার শ্যালিকার ছেলে।
-জ্বি, আপনি বেশ বুদ্ধিমতি তো! ঠিক ধরে ফেলেছেন।
আমার কথা শুনে মেয়েটা খিক খিক করে হেসে উঠল।
-আপনার হাসিটা বেশ চমৎকার, তবে আরো চমৎকার আমার চাচাত বোন মৌসুমির হাসি।
-তাই নাকি? (সহাস্যে বলল মেয়েটা)
-জ্বি
-আপনি কিন্তু আমাকে সূক্ষভাবে ইনসাল্ট(অপমান) করার চেষ্টা করছেন।
-স্যরি,যাই হোক আপনার নামটা শুনতে পারি?
-জ্বি অবশ্যই, আমি দিনা। ক্লাস টেইন-এ পড়ছি ত্বেজগাঁও হাই স্কুলে। আপনি?
-আমি মোঃআরাফাত হোসেন, এবার এসএসসি পাস করলাম। বতর্মানে মিরপুর কলেজে ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছি। পাশাপাশি আমি একজন শখের লেখক এবং সাহিত্যিক।
-ওরে বাবা, আপনার পদতো অনেক বিশাল! (মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল)
আমি মৃদু হাসলাম। কোন কিছুই আমার জীবনে সুখ দিতে পারবে না, যদি মৌসুমি আমার জীবনে না আসে।
মুখে বললাম- হয়তো বা। আচ্ছা, আপনি খালুর কি হন?
-আমি এ বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে। বাসা স্কুলের পাশেরই একটা বিল্ডিং এর তিনতলায়। মাসে মাসে আমিই ভাড়া উঠাতে আসি।
-আপনার বাবা?
মেয়েটা আমার কথায় যেন একটা বৈদ্যুতিক শক খেল।

-বাবাতো নেই। মারা গেছেন, মানে মারা হয়েছে। তেজগাঁও-এর সন্ত্রাসীরা আমার বাবাকে গুলি করে মেরেছে। আমার বাবার অপরাধ ছিল তিনি একটা খুনের চাক্ষুশ স্বাক্ষী ছিলেন। যাক বাদ দিন এসব কথা। আপনার বাসা কোথায়?
-আমার বাসা মিরপুর-১ নাম্বারে।
এর মধ্যে খালু এসে উপস্থিত হলেন। হাতে পোটলার ভিতর পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা।
-আরে দিনা, কখন আইছ তুমি?
-এইত কাকা, কিছুক্ষণ আগে।
-বস বস, (বলে খালু চেয়ার এগিয়ে দিলেন)।
দিনা চেয়ারে না বসে আমার সাথে বিছানার এক পাশে বসে পড়ল।
খালু একটা বাটিতে পেয়াজু, পুরি আর সিঙ্গারা ঢেলে দিলেন।
খালু পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দিনাকে বললেন- ও হইল আমার শালির পোলা।
খালুর কথা শুনে আমি আর দিনা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম।
-খাও, খাও না কেন তোমরা? (বলে খালু বাটি এগিয়ে দিলেন মাঝখানে)
-খালু আমি একটু এফডিসিতে যাব।
-যাইস, মাগরিবের আজান দিয়া লউক। টাকা আছেনি তোরতে? একশ টাকা লাগব কইলাম ঢুকতে।
-কেন কেন? টাকা লাগবে কেন এফডিসিতে ঢুকতে? ওটা কি চিড়িয়াখানা না জাদুঘর যে টাকা লাগবে?
-দাড়োয়ান টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না। (বোঝালেন আমাকে খালু)
-আশ্চর্য! (অবাক হই আমি) জনগণের টাকায় যারা বেঁচে আছে তারাই কিনা জনগণকে টাকা ছাড়া ঢুকতে দেয় না!
-আমাগো সোহাগে গেছিল না। লগে আরও দুইজন আছিল। তিনজনেরতে দাড়োয়ান দুইশ টাকা রাখছে।
-আচ্ছা, টাকা লাগলে দেখা যাবে।
-এইল একশ টাকা (খালু আমাকে টাকা দিতে চান) ।
-আরে করেন কি খালু? আমার কাছে টাকা আছে তো।
-এফডিসির কথা এত জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি কি এখন এফডিসিতে যাবা? (দিনা প্রশ্ন করল)
আমি লক্ষ্য করলাম ও আমাকে আপনি থেকে তুমি করে বলা শুরু করেছে।
-হ্যাঁ, এখনই যেতে চাই।
-চল, আমি তোমাকে এগিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দেই। খালুর নিকট হতে বিদায় নিয়ে এসে পড়লাম। এফডিসি দেখে ফার্মগেট ঘুরে তারপর মিরপুর যাব।
দুই মিনিট পর আমরা রেললাইনে এসে উঠলাম। আমি আর দিনা পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
শেষ বিকেলের মৃদু রোদের আভা দিনার গায়ে পড়ছে। তাতে ওর ফর্সা ভরাট মুখটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। নীল রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়া, কাজলটানা মায়াবী দুই চোখ, আকর্ষণীয় হ্রদয়কাড়া হাসি সাধারণের মাঝেই অত্যন্ত অসাধারণ এবং চমৎকার একটি মেয়ে।
যেকোন ছেলেকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দিনা।
হঠাৎ দিনা বলল- আরাফাত, তোমার হাতটা একটু ধরব?
-ধর।
কিছুক্ষণ নিরিবিলি হাঁটা। আবার প্রশ্ন করল দিনা- আচ্ছা তুমি কি কাউকে ভালবাস?
-হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।
দিনা মৃদুভাবে শিউরে উঠল। বলল- কাকে?
-আমার আপন চাচাত বোন মৌসুমিকে।
-সেকি তোমাকে ভালবাসে?
-না।
-আশ্চর্য! তোমাকে ভালবাসে না?
-বললাম তো, না।
-কখনও কি ভালবাসেনি? আবার প্রশ্ন করে দিনা।
-হ্যাঁ বেসেছে, মানে বাসেনি। ইয়ে ভালবেসেছে নাকি ভালবাসে নি তা এখনও বলতে পারব না। তবে ওকে যখন আমি প্রেম নিবেদন করেছিলাম, তখন ও গ্রহণ করেনি। পরে করল, তাও একটা শর্ত। এস.এস.সি পাস করতে হবে। আমি আস্তে আস্তে ওর প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে গেলাম। মৌসুমিও দুর্বল হয়ে পড়ল আমার প্রতি। ভালবাসার স্বপ্ন, আশা আর কল্পনার জাল বুনতে শিখাল ও আমাকে।

তারপর, তারপর হঠাৎ একদিন আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে বলল- “আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি যা কিছু করেছি তোমার সাথে, তা ছিল আমার অভিনয়। এমন কি তোমাকে জড়িয়ে ধরা, তোমার সাথে কিস (চুম্বন) করা এগুলোও ছিল আমার অভিনয়ের অংশ। তোমার সাথে অভিনয় না করলে তুমি এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে না। তুমি আমাকে ভুলে যাও, কারণ আমি ফয়সাল নামের আরেকজনকে ভালোবাসি।”

আমি খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু মৌসুমি আমার কান্নার মুল্য দেয়নি। আমার কষ্ট একটাই। কেন ও আমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাল? ভালোবাসার নামে কেউ কারো সাথে অভিনয় করে? তাও আবার আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে।

-পাষন্ড ডাইনী, মন্তব্য করল দিনা।
-খবরদার দিনা, আমি গর্জে উঠলাম। মৌসুমিকে নিয়ে কোন বাজে কথা আমার সামনে বলবে না।
-ও আচ্ছা, স্যরি, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও আমাকে।
আমি দিনার চোখের কোণে পানি দেখতে পেলাম। আমার হঠাৎ ভিষণ মন খারাপ হল। বাপ মরা মেয়েটাকে আমি ধমক দিয়েছি মৌসুমির কারণে।
ডানহাত দিয়ে দিনার চোখের কোণ হতে পানি মুছে দিলাম।
-স্যরি, তুমি কাঁদছ কেন? আসলে আমি একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম।
দিনা আমার বুকে মাথা রেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল।

আমি ওকে সান্তনা দিতে লাগলাম। দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর আমাদের পাশ কাটালো একটি আন্তঃনগর ট্রেন।

-বিশ্বাস কর, তোমার মত ভাল ছেলে আমি আগে কখনও দেখিনি। কেন জানি তোমাকে আমার ভাল লেগে গেছে।
-তুমি ভুল ভাবছ দিনা। আমি তেমন ভাল ছেলে নই। আমার মধ্যেও শয়তান বাস করে। তাছাড়া আমি মৌসুমিকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারব না। এটা আমি ওর কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছি।
-কিন্তু ওই মেয়েটাতো তোমাকে বুঝতে পারছে না।
-তুমি কিচ্ছু ভেবনা। দেখবে আমার মৌসুমি একদিন ঠিকই আমার কাছে এসে হাজির হবে।

-আরাফাত?
-কি দিনা?
-সন্ধ্যা হয়েছে, আমাকে চলে যেতে হবে। তোমার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দাও।
-লেখ 01917-592041 , মিসকল দিলেই হবে।
-সে আমি দেখে নিব। এবার দয়া করে আমাকে বিদায় দাও।
-ঠিক আছে এসো।
দিনা চলে যাওয়ার সময় বলল- আবার এসো।
-আচ্ছা আসব।


• এফডিসির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। বিশাল সাইনবোর্ডে লাল-নীল আলোয় লিখা আছে ;

‘BFDC’

এফডিসির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সকলে অধীর আগ্রহের সাথে গেটের ফাঁক দিয়ে এফডিসির ভিতরে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয় নায়ক-নায়িকা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যদি একটু সামনা সামনি চক্ষুদর্শণ করা যায়।
অধিকাংশই গার্মেন্টস কর্মী, কুলি-মজুর আর ছোট-খাট খুচরা ব্যবসায়ী।
সাধারণ জনগণের সময় কোথায় যে তাদের কাজ-কর্ম ফেলে বাংলাদেশের পৃথিবী কাঁপানো সুপারস্টারদের দেখতে আসে!!

তাইতো নায়ক-নায়িকা, পরিচালকরা আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবার সাথে মুড দেখাতে পারেন না। দেখালেও দেখান গার্মেন্টস শ্রমিক কিংবা কুলিদের সাথে।
এক জায়গায় দেখতে পেলাম আট-দশটা ছেলে এফডিসির দাড়োয়ানের সাথে দর কষাকষি করছে।

আমি তাদের সামনে দাঁড়ালাম।
দাড়োয়ান বলছে- দশজন ঢুকবেন, একদাম এক হাজার টাকা দিবেন।
ছেলে- ভাই পাঁচশ রাখেন না।
-না না কম হবে না। ঢুকলে ঢুকেন, নেয়লে যান গা।
ছেলেগুলো বিমর্ষ মুখে আরো তিনশ টাকা বের করে দাড়োয়ানকে আটশ টাকা দিল। ভিতরে ঢুকে ছেলেগুলো এমনভাবে তাকাতে লাগল যেন জান্নাত দর্শণে এসে পড়েছে।
আমি অবাক হলাম এ দৃশ্য দেখে। নায়ক-নায়িকাদের প্রতি তাদের এত ভালবাসা!

নাকি গোটা উঠলে পাছা যেমন চুলকায়, এও তাদের এমন এক চুলকানি।
এফডিসি ঘুরব, তাও কিনা দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে ঢুকতে হবে। আমি কিছুক্ষণ পায়চারি শুরু করলাম। দোকান থেকে একটা বেনসন সিগারেট কিনে মুখে ধরালাম। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে মুড নিয়ে সোজা এফডিসির ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে ঢুকে আমার বেশ আত্নতৃপ্তি হল।
প্রথমে একটা নিচতলা ছোট বিল্ডিং, তারপর লাল একটা বহুতল বিল্ডিং। তার সামনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের বিভিন্ন নির্দেশনা ঝুলানো রয়েছে।
পুরো চত্বর ঘুরেও আমি মিডিয়ার কোন পরিচিত লোক দেখতে পেলাম না। সম্ভবত সন্ধ্যার অনেক পরে এসেছি বলে হয়তো।
বিকালে আসলে নিশ্চয়ই দু-চারজন নায়ক-নায়িকা দেখতে পেতাম।
বাংলার নায়ক-নায়িকাদের আমার মনে হয় যেন চিড়িয়াখানার জন্তু। লোকে কত শখ করে দাড়োয়ানকে টাকার টিকেট দিয়ে তাদের দেখতে আসে।
দশ মিনিট ঘুরে ফিরে আমি এফডিসি হতে বের হলাম। সাথে সাথেই দশ-বারজন ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এফডিসির মাস্তান নাকিরে বাবা?
মোবাইল আর টাকায় হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেই একটা ছেলে আমাকে বলল- ভাইজান, একটু এদিকে আহেন।
-কেন ভাই, কি হয়েছে?
-আহেন না ভাই, বলে আমাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই এফডিসির বামপার্শস্থ একটা দোকানে বসাল।
ছেলেটা বলল- কি খাইবেন ভাই, গরম না ঠান্ডা?
-ঠান্ডা মানে, আমাকে কেন খাওয়াবেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
-ওই হাফ লিটার মোজ়ো দেও তো। দোকানীকে বলল ছেলেটা।
আমার এক হাতে মোজ়ো আর এক হাতে চা।
-ভাই কি সিগারেট খান?
-বেনসন খাই, মানে, কেন ভাই?

সে জবাব দেয় না। এবার হাতে চায়ের সাথে বেনসন সিগারেটও এসেছে।
আমি অবাক হই। এরা খাওয়াচ্ছে কেন আমাকে!
-ভাই, আমার নাম আইউব। নারায়ণগঞ্জ গার্মেন্টসে কাজ করি। ভাইয়ে কি করেন?
-আমার নাম মোঃ আরাফাত হোসেন, পড়াশোনা করছি। বাসা মিরপুর এক নাম্বারে।
-ভাই ঝালমুড়ি খাইবেন?
-ঝালমুড়ি? আমি মুখ দিয়ে প্রশ্ন করতেই আইউব অর্ডার দিয়ে দিল। হ্যাঁ কিংবা না বলার প্রয়োজন পড়ল না।
-দশ টাকার মুড়ি দেওতো ভাইরে। সুন্দর কইরা বানাইয়া দিও।
আইউব অর্ডার দিয়ে ফেলে।
আমি চুপচাপ খাবার খেতে থাকি। এদের আচরণে মনে হচ্ছে না যে এরা চোর-বাটপার। বরং মনে হচ্ছে এরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ।
কিছুক্ষণ পর আইউব আমাকে প্রশ্নগুলো করল- ভাই আপনে ভিতরে ঢুকছেন কেমনে? আপনে কি সিনেমার কোন লোক? নাকি আপনের পরিচিত কেউ আছে? আমরা কি কি ভিতরে ঢুকতে পারমু না?
ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন।
আমি চোখ হতে চশমাটা নামিয়ে বললাম- আস্তে ভাই,আস্তে। আমি ভিতরে ঢুকেছি পায়ে হেঁটে, আমি সিনেমার কোন লোক না, আমার পরিচিত কেউ এই ঢালিউডে মানে সিনেমায় নেই এবং আপনারাও ভিতরে ঢুকতে পারবেন।
-কই দাড়োয়ানতো ভিতরে ঢুকতে দেয় না।
-দাড়োয়ানের কাছ থেকে আপনারা অনুমতি নিতে যান কেন? আমিতো কারো অনুমতি নেই নি। সামান্য একজন দাড়োয়ান কিভাবে আপনাদের থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়?
আমার এ কথার জবাব কেউ দিতে পারল না।
আরো ঘন্টাখানেক আইউব আর তার বন্ধু-বান্ধবদেরকে উপদেশ ঝাড়লাম।
বিদায় নিয়ে হাযির হলাম ফার্মগেটে। ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত আটটা চল্লিশ বাজে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ফার্মগেটের ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে। অদূরেই বিখ্যাত আনন্দ সিনেমা হল। উপরে বিশাল এক টিভি সেট করা। তাতে একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে।
এই মূহুর্তে পুরো ফার্মগেটে বাস,ট্রাক,রিক্সা,গাড়ি,মোটর সাইকেল প্রভৃতির ছড়াছড়ি। সারাদিনের কাজ-কর্মের পর মানুষ নীড়ে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আনন্দ সিনেমা হলের সামনে যেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। এই মুহূর্তে ছবির টিকেট বিক্রি হচ্ছে হলের কাউন্টারে। ছবির নাম- “ স্বামী কেন আসামী ”।
কয়েকশ মানুষ টিকেট কেনার জন্য কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
অধিকাংশই শ্রমিক কিংবা রিক্সাওয়ালা। কারণ আজকাল এরা ছাড়া বাংলা ছবি কেউ খুব একটা দেখে না।
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে গেল। অনেকেই এতে ক্ষেপে গিয়ে হাঙামা শুরু করল। হলের দাড়োয়ান যেইমাত্র হলের দড়জা খুলে দিল, অমনি সবাই একসাথে হট্টগোল আর চেঁচামেচি করে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকতে লাগল।
আমি বিস্ময়ের সাথে এসব দৃশ্য দেখছিলাম। অনেকে হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে যেয়ে মোটামুটি ব্যথা পেল। কিন্তু সেদিকে তাদের কোন কেয়ার নেই।
আরে বাবা! টিকেটের মধ্যে যে সিট নাম্বার দেয়া আছে তা দেখে তো আসল জায়গায় বসা যাবে।
তাহলে এত ধাক্কাধাক্কির দরকার কি? নাকি হলগুলোতে টিকেটের নাম্বার আছেই সার, সিটের কোন নাম্বার নেই!
কি জানি, আমি কোনদিন হলে যাইনি। তাই বলতেও পারব না।
হলের দর্শক সব ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম বোরখা পড়া কয়েকজন মেয়ে আর মহিলা ঘোরাফেরা করছে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক।
হঠাৎ বোরখা পড়া এক মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ নাড়া দিল।
আমিতো হতবাক। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আমার সামনে এসে বলল- কি লাগব নাকি?
আমি বললাম- কত?
-হোটেল ভাড়া সহ পাঁচশ টাকা।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ইতঃস্তত করলাম। তারপর বললাম- দেড়শ টাকা দিব।
-কি? মেয়েটি শুনতে না পেরে আবার প্রশ্ন করল।
-দেড়শ টাকা।
-হাউয়ার পোলা, দেড়শ টাকা দিয়া মাগী খাইতে আইছস! যা ভাগ এহান তে।
আমি তাড়াতাড়ি মান-সম্মান নিয়ে সরে পড়লাম। আমি যে ফাইজলামী করছিলাম তা কি মেয়েটা বুঝতে পারেনি? আসলে পারার কথা নয়। কারণ জীবন এদের কাছে অন্যরকম অর্থের হয়ে গেছে। যেখানে নেই কোন হাসি কিংবা ঠাট্টা।
যাক অনেক হয়েছে। আজকে সারাদিন আমি খালি ঘুরেছি আর ঘুরেছি। এবার বাসায় যেতে হবে। ফার্মভিউ সুপার মার্কেট হতে একটা লাচ্ছি খেয়ে গলা জুড়ালাম। তৃষ্ণায় মনে হচ্ছিল ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হওয়া শুরু হল। সারাদিনের ব্যস্ততার পর ঢাকার ক্লান্ত মানুষগুলো ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। আমিও একটা মিরপুরের বাস পেয়ে উঠে পড়লাম।


বিঃদ্রঃ এটি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখা হয়েছে।


সমাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন